Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

অগ্রাধিকার দিতে হবে উচ্চ শিক্ষা খাতকে

সায়মা জাহান সরকার

জুন ৫, ২০২১, ০৫:৩০ এএম


অগ্রাধিকার দিতে হবে উচ্চ শিক্ষা খাতকে

একটি রাষ্ট্রের বার্ষিক সাধারণ আয়-ব্যয়ের হিসাবের সমষ্টিই হলো বাজেট। এ বাজেটে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে থাকে বিশেষ বরাদ্দ। কিন্তু একটি রাষ্ট্রকে সমুন্নত করতে প্রয়োজন উচ্চ শিক্ষা তথা গবেষণাখাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। ৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। 

দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট এটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের এটি তৃতীয় বাজেট। এ বাজেটে এবার শিক্ষা খাতে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গতবছর ছিল ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ যা মোট জিডিপির শতকরা প্রায় ২ দশমিক ১০ ভাগ। 

পৃথিবীর সব দেশ মিলে ঠিক করেছিল পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজানো প্রয়োজন এবং তা করতে গেলে প্রয়োজন শিক্ষার। আর শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুন্দর পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় অর্থের। 

এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ডাকার চুক্তি এবং সেখানে প্রতিটি দেশ অঙ্গীকার করেছিল। তারা বাজেটের শতকরা ২০ ভাগ অথবা জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ শিক্ষার পেছনে ব্যয় করবে। আমাদের বাংলাদেশও সেখানে স্বাক্ষর করেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, তিনি শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ চান। তাঁর সময়ে তৈরি কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন তাদের রিপোর্টে বলছে, শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ৫ থেকে ৭ শতাংশ দরকার। বঙ্গবন্ধুর দলটিই এখন ক্ষমতায়, কিন্তু তারা শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ২ শতাংশের বেশি কিছুতেই বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না।

যেখানে পার্শবর্তী দেশগুলোর শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ভারতে প্রায় ৪ শতাংশ ও নেপালে ৩.৭ শতাংশের উপরে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কম হওয়ার ফলে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও বাড়ছেনা শিক্ষার গুণগত মান (যদিও এটি একমাত্র কারণ নয়)। 

তাইতো প্রতিবছর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে ক্রম নির্ধারণ করা হয় তাতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান সন্তোষজনক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক মান বা ক্রম নিয়ে ইদানিং পত্রিকাগুলোও সরব এবং চলে নানা রকমের সমালোচনা। উঠে আসে বিভিন্ন তথ্য, তত্ত্ব ও উপাত্তের সমাহার।  

আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তলানিতে থাকার বিষয়টি প্রকটভাবে চোখে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনারও কোন শেষ নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমানভাবে সচেষ্ট নয়।

টাইমস হায়ার এডুকেশন যে পাঁচটি বিষয়ের মূল্যায়ন পূর্বক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংক নির্ধারণ করে তা পর্যালোচনা করলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্দশার মূল কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিষয়গুলো হচ্ছে- শিক্ষাদান, গবেষণা, গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি, শিল্প আয় এবং আন্তর্জাতিকতা। 

প্রতিটি বিষয়ের উপর মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে স্কোরিং করা হয়। শিক্ষাদানের স্কোর মূলত পাঁচটি কর্মক্ষমতা সূচকের উপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়- (১) খ্যাতি জরিপ, যার মাধ্যমে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের মান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় (২) শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাত (৩) পিএইচডি শিক্ষার্থী-স্নাতক শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাত (৪) প্রতিজন শিক্ষকের বিপরীতে কতজন পিএইচডি শিক্ষার্থীকে সনদ দেওয়া হয় তার সংখ্যা এবং (৫) শিক্ষাদান থেকে প্রতিষ্ঠানের আয়। 

গবেষণার স্কোর নির্ধারণ করা হয় তিনটি সূচকের উপর ভিত্তি করে। যেগুলো হলো (১) খ্যাতি জরিপ, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে সমসাময়িক গবেষকরা কিভাবে মূল্যায়ন করেন তা নির্ধারণ করা হয় (২) গবেষণা আয়, যার মাধ্যমে গবেষণার গুরুত্ব ও মান নির্ধারণ করা হয় এবং (৩) গবেষণার পরিমাণ অর্থাৎ ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি পরিমাণ উন্নত মানের গবেষণাপত্র প্রকাশ করছে তার উপর। 

সমসাময়িক গবেষকরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, উদ্ধৃতির সংখ্যা তার নির্দেশক। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প আয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার প্রায়োগিক দিক নির্দেশ করে। বিশেষত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয় সমূহের জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিকতার স্কোর তিনটি সূচকের উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়। (১) দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীর অনুপাত (২) দেশি-বিদেশি শিক্ষক বা গবেষকের অনুপাত এবং (৩) গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিমাণ।

উল্লেখ্য, পিএইচডি শিক্ষা মূলত গবেষণা ভিত্তিক। কাজেই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আমাদের দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের উপরের দিকে আনতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে উন্নতমানের গবেষণার কোনও বিকল্প নেই।

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত যার বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায়  ৪৬,১৫০। পক্ষান্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় যার প্রতিষ্ঠা ২০১২ সালে এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৬,১০২। কিন্তু প্রায় শতবর্ষী একটি প্রতিষ্ঠান ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ এ ৫২তম সমাবর্তনে মাত্র ৫৭ জনকে পিএইচডি সনদ প্রদান করে (১ বছরে)। 

অপরদিকে ভারতের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় যার বয়স এখনও ১০ হয়নি সেই প্রতিষ্ঠানটিই প্রতি বছর ১০০ জন পিএইচডি গবেষককে সনদ প্রদান করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় যার সাথে ভারতের নবীন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক সংখ্যার তুলনা। এ থেকেই বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার চিত্র সহজেই পরিমেয়।

এই যে পিএইচডি গবেষকদের এত পার্থক্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তার প্রধান কারণ উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়ায়। তারা গবেষণায় পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। 

উদাহরণস্বরূপ, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন পিএইচডি গবেষকের মাসিক সম্মানী বা বৃত্তি বাংলাদেশী সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকদের মাসিক সম্মানীর থেকে বেশি। আবার ১৯৭৯ সালে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্ত হওয়া (স্বাধীনতাপ্রাপ্ত) ইরানও গবেষণা ভর্তুকি বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের গবেষণা খাতকে করেছে সমৃদ্ধ। 

বাংলাদেশের বাইরে গবেষণায় পর্যাপ্ত বৃত্তি প্রদান  করা হয়, যার আওতায় গবেষকের সম্মানী এবং গবেষণা ব্যয় দুই-ই থাকে যা শিক্ষাখাত তথা বিশ্ববিদ্যালয় জোগান দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে গবেষণার চিত্র এত নাজুক কেন এবং কেন গবেষণা বৃদ্ধি পাচ্ছে না সর্বাগ্রে এর কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। 

আমাদের দেশের গবেষণার প্রতিবন্ধকতার অন্যতম কারণ প্রয়োজনীয় অর্থের অপ্রতুলতা। যেখানে গবেষককে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হলেও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে তা থেকে নিবৃত্ত হয় এবং গবেষণা করাকে অসার মনে করে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ঝাপিয়ে পড়ে। 

তাই দেশের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সহযোগিতা যার মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই  জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি তা মোট বাজেটের ২০ ভাগে উন্নীত করার চেষ্টা করতে হবে, তবেই দেশের শিক্ষার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত যেমন হবে তেমনই দেশের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশকেও করা যাবে সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আমারসংবাদ/এআই