Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ক্রিকেট, বলিউড আর দেশপ্রেমের মিশ্রন ‘‌৮৩’‌

বিনোদন ডেস্ক

ডিসেম্বর ২৩, ২০২১, ০৯:৫০ এএম


ক্রিকেট, বলিউড আর দেশপ্রেমের মিশ্রন ‘‌৮৩’‌

শেষ বল, ব্যাটে লাগতেই হাওয়াতে, ছয় না আউট, রুদ্ধশ্বাস গ্যালারি, ১৯৮৩ সালের স্মৃতিতে আরও একবার ভাসল ভারত। 

৮৩- সিনেমার গল্প কোনও অজানা কিছু নয়, এ গল্পের আগাগোড়া সবটাই দর্শকের জানা। এ গল্প বাইশ গজের রূপকথা যাকে পর্দায় আবারও বাঁচিয়ে তুলেছেন কবীর সিং। এই গল্পের শুরু এমন একটা সময় যখন ক্রিকেট দুনিয়ায় ভারতকে কেউ পাত্তা দিত না। এ গল্প শুধু ২২ গজের আট ঘণ্টার ব্যাট বল উইকেটের লড়াই নয়। 

২২ গজের বাইরে এক দেশের প্রতি শ্বেতাঙ্গ তথা গোটা বিশ্বের চরম অবহেলা, অসম্মানকে কুর্নিশে বদলে দেওয়া একদল তরুণের হিরোইজমের গল্প। কিভাবে একটা আন্ডারডগ টিম বিশ্ব ক্রিকেটের জায়েন্টদের দুরমুশ করে জিতে নেয় সেরার সম্মান। পর্দায় সেই রূপকথাকেই পরিবেশন করেছেন পরিচালক কবীর খান।

পরিচালক কবীর সিং এমন একটা প্রজন্মের কাছে বিশ্বকাপ জয়ের গল্প শোনাতে বসেছেন, যারা ২০১১-এর বিরাট রঙিন ফ্রেমে ধোনি, যুবরাজ, সচিন, বিরাটদের কৃতিত্বে বেঁচেছেন। সেই মহান কীর্তির ভিত যেখানে গাঁথা হয়েছিল সেই ৮৩-এর লর্ডসের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন কবীর খান। 

গল্পে ক্রিকেটের ২২-গজের যুদ্ধের পিছনেও কপিল দেব, শ্রীকান্ত, মোহিন্দরের দলকে যে অসম লড়াই লড়তে হয়েছিল সেই উপাখ্যান পর্দায় মেলে ধরলেন পরিচালক। 

১৯৮৩ সালের ২৫ জুন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা ভারতীয় দলের পুরো দলকে চিত্রিত করা হয়েছে এই সিনেমায়। ক্রিকেটের ইতিহাসে এই তারিখ সর্বদা জ্বলজ্বল করবে।

একটা দল যার অধিনায়ক ইংরাজিতে সড়গড়ও নন। প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব দিতে শব্দ খুঁজতেই প্রবল বিড়ম্বনায় পড়েন। তবুও ব্রিটিশ মিডিয়া থেকে ইংল্যান্ডের রানি কারওই মুখোমুখি হতে ভয় পান না। ভিভ রিচার্ড হোক বা ক্লাইভ লয়েড ব্যাট-বলেই মুখ বন্ধ করেন। তার দলকে কহতব্যের মধ্যেই ধরে না কেউ। এমনকী তাঁর নিজের দেশের মিডিয়ারও তাদের প্রতি আস্থা ছিল না। 

মিডিয়ার অসম্মানজনক প্রশ্ন, ম্যানেজার মান সিংয়ের লর্ডসের পাস চাইতে গিয়ে অপমানিত হওয়া সবকিছুই তাদের জয়ের জন্য বারুদের জোগান দেয়।

অবশেষে একটা আণ্ডার ডগ টিম নিজেদের ক্রিকেটীয় দক্ষতায় বিশ্বকাপ জিতে যায়। জবাব দেয় সকল অপমানের। সেই জয়ের অসাধারণত্বের খুঁটিনাটিই তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায়। 

কবীর খানের পরিচালনায় এই সিনেমায় মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রনবীর সিং, দীপিকা পাড়ুকোন, পঙ্কজ ত্রিপাঠি।

যে দেশে ক্রিকেটকে ধর্ম হিসাবে দেখা হয়, সেখানে বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমায় উঠে আসল ১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্বকাপ জেতার ঐতিহাসিক গল্প, যা ভারতীয়দের কোনও স্বপ্নপূরণের চেয়ে কম ছিল না।

আর তাই এই সিনেমা নিয়েই দর্শকদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। সিনেমা নয় কবীর সিংয়ের ৮৩ আসলে একটা টাইম মেশিন। যে টাইম মেশিনে মিলে গিয়েছে ১৯৮৩ আর ২০২১। এই গল্পের শুরু থেকে শেষ জানা সত্ত্বেও আড়াই ঘণ্টা টানটান উত্তেজনায় দর্শকদের আসনে বসিয়ে রাখতে ক্রিপ্টে একের পর এক মোচড় এনেছেন পরিচালক কবীর খান। 

মিডিয়ার অসম্মানজনক প্রশ্ন, ম্যানেজার মান সিংয়ের লর্ডসের পাস চাইতে গিয়ে অপমানিত হওয়ার দৃশ্য ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদেরও রক্ত গরম করার জন্য যথেষ্ট। 

বিশ্বকাপ জেতার অসাধারণত্বের খুঁটিনাটিও দর্শকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমা। যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিকেট জায়েন্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের বর্ণনায় বলা হয়েছে, 'উসকি হাইট ৭ ফুট হ্যায়। হাত অর ২-২.৫ ফুট উপর যাতা হ্যায়। উপর সে ২-৩ ফুট জাম্প করকে বল ডালতা হ্যায়। আব বাতাও ১২ ফুট উঁচে সে আতি হুয়ি বল খেলনা ক্যায়সা হোগা!' 

কপিল দেবের টিমের একের পর এক চ্যালেঞ্জ এভাবেই এসেছে পর্দায়। ড্রেসিংরুম স্পিচ, টিম বাসে কপিল দেবের কমিক স্পিচ, শ্রীকান্তের এক পার্টিতে ব্রিটিশ মিডিয়াকে দেওয়া জবাবের দৃশ্য আলাদা করে উল্লেখ্য। ক্রিকেটের সিনেমায় ক্রিকেটের দৃশ্যগুলিতে বাস্তব, অতীত, ভিএফেক্স-র সুচারু মিশ্রণে নিখুঁত।

ক্যাপ্টেন হিসাবে রণবীর সিং নেতৃত্ব দিলেও, তাঁকে অসামন্য সমর্থন করেছেন সিনেমার অন্যান্য অভিনেতারাও, যাঁদের অসাধারণ পারফর্ম দর্শককে অবশ্যই মুগ্ধ করবে। সিনেমায় প্রত্যেক অভিনেতাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যা খুব সুন্দরভাবে চূড়ান্ত মুহূর্তে যোগ হয়েছে। সেটা কপিলের কোচ পিআর মান সিং অর্থাৎ পঙ্কজ ত্রিপাঠির সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হোক বা কপিল দেবের সুনীল গাভাস্কর অর্থাৎ তাহির রাজ ভাসিনের বসঙ্গে টেনশনের মুহূর্ত হোক, প্রত্যেক দৃশ্য এতটাই জীবন্ত ছিল যে মনে হতেই পারে আপনি স্বচক্ষে ৮৩'‌ সালের বিশ্বকাপ জয়ের দিকে এগোনো ভারতীয় দলের সফর দেখছেন। ক্রিকেট পিচে প্রতিটি খেলোয়াড়ের চোখে উদ্বেগ ও ব্যাটিং-এর দৃশ্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

কবীর খান প্রতিটি খেলোয়াড়কে আবেগ দিয়ে রঙ করেছেন এবং কপিল দেবকে পরিপূর্ণ দল থেকে একটু আলাদা করে তুলে ধরেছেন। যিনি জানতেন যে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের  হাস্যরস দুর্দান্ত বা বলবিন্দর সাধুর  বড় ম্যাচের আগে ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়েছে। ছোট ছোট এই মুহূর্তগুলি '‌৮৩'‌-কে দারুণভাবে সুন্দর ও বার বার দেখার যোগ্য বানিয়েছে। দর্শকরা জানেন ক্লাইম্যাক্স কি হতে চলেছে এবং শেষ দৃশ্য কি হবে। তা সত্ত্বেও ভারতীয় দলের মারা প্রত্যেক বাউন্ডারি ও ছক্কায় আপনি হাততালি না দিয়ে থাকতে পারবেন না। মনে হবে যেন সত্যি বিশ্বকাপের ময়দানে রয়েছেন। এই সিনেমার একটি দৃশ্য, যেখানে কপিল দেব ও মহিন্দর অমরনাথ এর মধ্যে কোনও সংলাপ না থাকলেও, তাদের একে-অপরের চোখের ভাষা বিনিময়, যার মধ্য দিয়ে দুই অভিনেতা নিজেদের আবেগ ও অনুভূতি বোঝাচ্ছেন, তা কোনও শব্দ হয়ত প্রকাশ করতে পারবে না। আর এটাই সিনেমার জোরদার ও পক্ত চিত্রনাট্যের ক্ষমতা। পরিচালক কবীর খান নির্মিত '‌৮৩'‌ ছবিটি নিজের মধ্যেই এই কটূক্তি এবং জেতার জেদকে তুলে ধরেছে, যা পর্দায় দৃশ্যমান।

পরিচালক ক্রিকেটিং শট, রিলের চমৎকার ব্যবহার এবং বাস্তব ফুটেজ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের বিশেষ করে ভিভিয়ান রিচার্ডস দেখানোর জন্য কোন কসুর রাখেননি। যা ক্রিকেট ভক্তদেরও সান্ত্বনা দেয়। এর বাইরে ইংরেজি সংবাদপত্রে লেখালেখি, কপিল-গাভাস্কারের ঝগড়া, বিবিসি ধর্মঘটসহ অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল।

যার কথা না বললে ৮৩-এর কথা বলা শেষ করাই যাবে না তিনি হলেন রনবীর সিং। কিন্তু, পর্দায় কোথায় রণবীর, সেখানে তো শুধুই কপিল দেব। কিংবদন্তি ক্রিকেটারের চলা, বলা, নটরাজ শটের বাইরে তার চোখের ভাষা, ইংরেজি না বলতে পারার বিড়ম্বনা... সিনেমার প্রতিটা পরতে রণবীর কপিলের প্রতিবিম্ব। বাজিরাও , খিলজির চেয়েও পর্দায় কপিল দেবকে ফুটিয়ে তোলা রণবীরের জীবনের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ সেই ইতিহাসের চরিত্রদের কোনও বাস্তব রেফারেন্স নেই, কিন্তু কপিল দেব আছেন। আর রক্তমাংসের কপিল দেবের পাশে আছেন পর্দার কপিল রণবীর সিং। 

কপিল দেবের স্ত্রী রোমির ভূমিকায় দেখা গিয়েছে রণবীরের রিয়্যাল লাইফের স্ত্রী দীপিকা পাড়ুকোনকে। তিনিও অসামান্য অভিনয় করেছেন, যিনি কপিল দেবের পাশে তার শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রণবীর ও দীপিকাকে বড় পর্দায় একসঙ্গে অনেকদিন পর দেখা গেল, যা এই সিনেমার আরও একটি ইউএসপি। রণবীরের পর আবারও সেরা কাজ পঙ্কজ ত্রিপাঠীর। পিআর মান সিং এই ছবিটি এবং দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সুতো, যা ক্রিকেট মাঠ এবং ড্রেসিংরুমের মধ্যে দূরত্ব কমিয়েছেন। পঙ্কজ ত্রিপাঠীর টাইমিং, ঘাড় নড়াচড়া আর চোখ আবার জাদু করল। ফিল্ম এবং বিশ্বকাপে পিআর মান সিংয়ের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটি থেকে বোঝা যায় যে গল্পের শুরু এবং শেষ উভয়ই পিআর মান সিং করেছেন।

২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের ছবিতে এত বড় একটা জিনিস কীভাবে আনা যায় সেটাই ছিল পরিচালক বা লেখকের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রতি মিনিটে আপনি একটি উপাখ্যান দেখেন, টিম ইন্ডিয়া নির্বাচন থেকে বিশ্বকাপ জেতা পর্যন্ত, প্রতিটি মুহূর্ত একটি গল্প। 

টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক কপিল দেব থেকে শুরু করে ম্যানেজার পিআর মান সিং, তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। ‘৮৩’ গায়ে কাঁটা দেওয়া এমন অদ্ভুত অনুভব যা ভারতবর্ষের ঊননব্বই বছর ব্যাপী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে অদ্যাবধি কোনও মুভিওয়ালা এত দরদের সঙ্গে কখনও ফুটিয়ে তোলেনি। ক্রিকেট নিয়ে তো সিনেমা আগেও হয়েছে। বায়োপিক হয়েছে। ‘ইকবাল’ বা ‘লগানের’ মতো সিনেমা হয়েছে, যেখানে গল্পের মাস্তুল এবং গন্তব্য দুটোই ক্রিকেট। কিন্তু সব মিলেজুলেও এই পরিমাণ ক্রিকেট সেখানে পর্দায় দেখানো হয়নি। 

এই সিনেমার অভিজ্ঞতা আপনাকে আবেগঘন করে তুলবে। কারণ এখানে ক্রিকেট, বলিউড আর দেশপ্রেম সবকিছুই আছে, যার মশলা পর্দায় এলে হাসায় আর কাঁদায়। ফিল্মটি দেখার সময় আপনার ক্রিকেট ভক্ত সত্ত্বা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে।

আমারসংবাদ/এডি