Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

মুম্বাই ডায়েরিজ ২৬/১১: এক ভয়ঙ্কর রাতের গল্প

বিনোদন ডেস্ক

জানুয়ারি ১১, ২০২২, ১১:১৫ এএম


মুম্বাই ডায়েরিজ ২৬/১১: এক ভয়ঙ্কর রাতের গল্প

ডায়েরির পাতায় লেগে রক্তের দাগ। ডায়েরির পাতায় কোথাও চোখের জলে লেখা মুছে গিয়েছে। তবুও ডায়েরিটা আছে, সযত্নে। পাতা ওল্টালে থাকলেই লেখাগুলো কী জীবন্ত হয়ে ওঠে এখনও! কানে তালা লেগে যায় একটানা গুলির শব্দে। তারই মাঝে কতজনের শেষ আর্তনাদ মিলে মিশে যায়। গুলি, পাল্টা গুলির লড়াইয়ের মাঝেই নিঃশব্দে আরও একটা লড়াই চলতে থাকে। জীবন বাঁচানোর লড়াই। মানবতাকে টিঁকিয়ে রাখার লড়াই।

আমাজন প্রাইম ভিডিওর ওয়েব সিরিজ ‘টোয়েন্টি সিক্স বাই ইলেভন - মুম্বাই ডায়েরিজ’ এই লড়াইয়ের গল্পই শোনায়। নিখিল আডবাণী এবং নিখিল গনজালভেস পরিচালিত এই ওয়েব সিরিজটি ছাব্বিশ এগারোর মুম্বাই হামলার সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর দলিল হয়ে উঠেছে। কল্পনার কিছু রঙ হয়তো মিশেছে কাহিনিতে, কিন্তু তা কোথাও অতিরঞ্জিত নয়। মোট আটটি এপিসোড রয়েছে সিরিজটিতে। প্রতিটি এপিসোডেই চিত্রনাট্যে টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন পরিচালক জুটি। আর বলতেই হয় সেই চেষ্টায় তাঁরা অনেকাংশেই সফল।

সন্ধ্যা নামার মুহূর্ত। স্বপ্নের নগরীর আলোকিত রাস্তা। হাইরাইজ বিল্ডিং। শান্ত সমুদ্রের জল কেটে বিচ্ছিন্ন এক সৈকতে এসে দাঁড়াল একটি ট্রলার। আধো অন্ধকারে পিঠে ব্যাগ নিয়ে লাফ দিয়ে নামল কিছু যুবক।

অন্য দিকে, ব্যস্ত মুম্বাই হাসপাতালে সদ্য আসা তিন জন ট্রেনি চিকিৎসক। বিখ্যাত সার্জেন কৌশিক ওবেরয়ের আন্ডারে তারা কাজ করবেন। এদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চিকিৎসকের মেয়ে দিয়া পারেখ। দিয়ার দাদুর অনেক অবদান রয়েছে এই মুম্বাই হাসপাতালে। সাধারণ ট্রেনি চিকিৎসক হিসেবে দিয়ার প্রথম দিন হাসপাতালে আসা অন্য দুই চিকিৎসক অহন, সুজাতার সঙ্গে।  

দিয়াকে বাকি দুই জনের চেয়ে একটু ভিন্নভাবে ট্রিট করে হাসপাতালের সবাই। সেটা সুজাতা ভালো চোখে দেখে না। তাই অহন দিয়ার সঙ্গে কথা বললেও সুজাতা তার সঙ্গে কোনো কথা বলে না। 

অন্যদিকে, তারা যে ডাক্তারের কাছে কাজ করতে এসেছেন সেই ডাক্তারও অত্যন্ত বিতর্কিত। যে কোনও রোগীর জীবন ফিরিয়ে দেওয়াই তার মূল লক্ষ্য। দুর্ঘটনায় মরণাপন্ন রোগী, পুলিশের কনফার্মেশন অপেক্ষা না করেই চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। এতে যদি নিয়ম ভাঙতে হয়, তিনি পরোয়া করেন না। এই নিয়ে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টরের সঙ্গে তার ঝামেলা লেগেই থাকে। তার একরোখা জেদের কারণে কর্মজীবন থেকে ব্যক্তিজীবনে তিনি সমালোচিত হতেই থাকেন।

তবে সবার জীবনের মোর ঘুড়িয়ে দেওয়ার সূচনা হয় সেদিন থেকে। একটি বিস্ফোরণ পাল্টে দেয় শত শত মানুষের জীবন। 

বিস্ফোরণ শুরু হয় ক্যাফে থেকে। কী আশ্চর্য, সেখানেই হামলার ঠিক আগের মুহূর্তে হাসপাতালের তথ্য দেওয়া নিয়ে সমর্থের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়েছিল মানসীর, সেই ভাবেই তারা ওখান থেকে বেরিয়ে আসে। এ দিকে আততায়ীরা ক্যাফেটেরিয়া থেকে ছত্রপতি শিবাজি বাস টার্মিনাস হয়ে প্যালেস হোটেল আক্রমণ করেছে। মৃত্যুর হাত থেকে কোনও মতে রেহাই পেল মানসী আর সমর্থ। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে কোনও ট্রমার লেশও ছিল না তাঁদের মুখে। মানসী ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর জন্য। আর হাসপাতালে নিষ্কর্মার মতো ঘুরে বেড়ায় সমর্থ।

ক্রমাগত বিস্ফোরণে আহত, হত রোগীরা উপচে পড়তে থাকে মুম্বই হাসপাতালে। চিকিৎসক, সিস্টাররা নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন না। তারই মধ্যে হাসপাতালে ডিউটি করে ফিরে যাওয়া এক হাসিখুশি নার্সের মৃত্যু, স‌বাইকে শোকগ্রস্ত করে। সবচেয়ে ভেঙে পড়ে সমর্থ।

ট্রেনিরাও ডাক্তারের ভুমিকা পালন করতে থাকে। এক সেকেন্ড নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। একের পর এক রুগী আসছে। কেউ বেঁচে যায়, কেউ শুধু হতাশা হয়ে রয়ে যায়।

শহরের বেশ কিছু বড় বড় হোটেলে আক্রমণ করে জঙ্গিরা। এর মধ্যে অন্যতম প্যালেস হোটেল। এই হোটেলে আটকে থাকে দিয়ার বাবা-মা এবং সেখানে কাজ করে ডাক্তার কৌশিকের স্ত্রী অনন্যা। সেও সমস্ত বাধা পেরিয়ে কর্তব্যে অবিচল থেকে সে অতিথিদের জীবন রক্ষা করে। 

অন্যদিকে, পুলিশ, মিলিটারি, প্যারা মিলিটারি যখন জঙ্গিদের রুখতে অবিচল তখন সাংবাদিক মানসীও নিজের চ্যানেলের টিআরপি বাড়াতে ব্যস্ত। এতো মানুষের মৃত্যু তার মাঝে কোন ইমোশন তৈরি করতে পারে না। স্বার্থপরের মতো কেবল সংবাদ সংগ্রহেই ব্যস্ত সে। এমনকি নিজের জীবনেরও পরোয়া করেনা সে। 

এদিকে গুলিতে ঝাঁঝরা মুম্বাই পুলিশের এটিএস প্রধানকে চিকিৎসার জন্য আনা হয় মুম্বাই হাসপাতালে। কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারে না কৌশিক। কিন্তু ধরা পড়া আততায়ী চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে বেঁচে থাকে। কর্তব্যে অবিচল চিকিৎসক কৌশিক ক্রুদ্ধ পুলিশ অফিসারের রিভলভারের মুখে দাঁড়িয়েও আততায়ীর চিকিৎসা করে। কারণ ডাক্তার হিসেবে তাঁর একমাত্র কর্তব্য রুগীর চিকিৎসা করা!

এদিকে একজন জীবিত আততায়ী পুলিশের হাতে বন্দি থাকে। কিন্তু এই খবর পৌঁছে যায় মানসীর কানে। আর দেরি না করে সাংবাদিক মানসী ইচ্ছাকৃত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাসপাতালে ঢোকে, ভেতরের তথ্য সংগ্রহের জন্য। আর তাতেই গোপন খবর, দু’জন আহত জঙ্গিকে যে পুলিশ ধরতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের হাসপাতাল এনেছে, তা ‘ব্রেকিং নিউজ’-এ প্রকাশ হয়ে যায়। ফল হয় ভয়াবহ। আক্রমণ করা হয় হাসপাতাল!

দৃশ্য চলে যায় ইসলামাবাদে। স্বাভাবিক জীবনযাপনে ‘সুপার বস’। থালা সাজিয়ে খাবার খায়, নিজের শিশু কন্যাকে আদর করে, নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে আর খোলা স্ক্রিনে দেখে মুম্বইতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। তার নির্দেশ আসে হাসপাতাল আক্রমণ করার, পুলিশের হাতে ধৃত জঙ্গিদের মেরে ফেলা অথবা উদ্ধার করার জন্য।

মরতে হয় অজস্র সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ঘুটঘুটে অন্ধকার করিডর দিয়ে দৌড়ে বেড়ান বিপন্ন মানুষ। এ দৃশ্য প্যালেস হোটেলেও দেখেছে দর্শক। পোকামাকড়ের মতো মানুষ মরছে। এই হাড়হিম যুদ্ধের মধ্যে বসে দর্শকও অবচেতনে জীবনভিক্ষা করে চলে, পলক পড়ে না তার!

তারই মধ্যে প্রতিটা আহত জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ লড়াই ট্রেনি চিকিৎসক অহান, দিয়া, সুজাতার। বিখ্যাত সার্জেন কৌশিক এবং তার সহকর্মীদের। রাত গড়িয়ে মধ্যরাত। অনেক খুনখারাপির পর আততায়ীরা চিকিৎসক চিত্রার শরীরে বোমা বেঁধে, তাকে ঢাল করে পালাতে চেষ্টা করে। 

কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। বোমের ডিক্টেটর হারিয়ে ফেলায় তারা পুলিশের হাতে ধরা পরে যায়। শেষ হয় এক বিভীষিকাময় রাতের। কিন্তু এই কালো রাত কেড়ে নেয় অসংখ্য মানুষের কাছের মানুষকে। ঠিক যেমন দিয়া হারায় তার মাকে। 

সিরিজটি শেষ হয়েছে দর্শককে স্বস্তি দিয়ে, যেখানে বেদনা এবং তুচ্ছতা ডিঙিয়ে চরিত্রগুলো অবশেষে আলোমাখা এক বৃহত্তর কর্মময় জীবনে পা রাখতে চলে।

প্রায় প্রত্যেকেরই অভিনয় অসম্ভব ভাল। কোথাও আরোপিত মনে হয়নি। ২৬/১১-র সেই ভয়াবহ রাত গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রদের সন্ত্রস্ত চোখের তলায় গভীর কালি, ঘেঁটে যাওয়া চুল, সাজগোজ গলে যাওয়া ক্লান্ত মুখ... দর্শককে খুব সহজেই তাদের লড়াইয়ের সঙ্গী করে তুলেছে।

চিকিৎসক কৌশিকের চরিত্রে মোহিত রায়না, চিকিৎসক চিত্রা দাসের চরিত্রে কঙ্কনা সেনশর্মা, অনন্যার ভুমিকায় টিনা দেশাই, মানসীর চরিত্রে শ্রেয়া ধন্বন্তরি, দিয়া, অহান, সুজাতা প্রত্যেকেই দুর্দান্ত!

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চিকিৎসক চিত্রা এবং জঙ্গিদের কাঁপা গলায় গান, শাহরুখ খানের কথা বলা... এক অন্য আবেগ নিয়ে আসে। জীবন মৃত্যুর মাঝখানের এক চিলতে জমিটিকে বারাবার এ রকম নৈব্যর্ক্তিক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে সমস্ত সিরিজটিতে।

আমারসংবাদ/এডি