বরেন্দ্রর বাতিঘর পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি

উই পোকায় খাচ্ছে শত বছরের সংগ্রহ

মুক্তাদির আহমেদ, গোদাগাড়ী (রাজশাহী) প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৩, ০৫:১৯ পিএম

উই পোকায় খাচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্রর বাতিঘর পানিহার পাবলিক লাইব্রেরির শত বছরের সংগ্রহ করা বই। গোদাগাড়ী উপজেলায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত পানিহার পাবলিক লাইব্রেরির ১৯৪৫ সালে স্থাপিত হয়। 

মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে পানিহার পাবলিক লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে দেয়ালে বেশ কিছু গুণী মানুষের ছবি। ছবিতে দেশি-বিদেশি কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, বিখ্যাত মনীষীরাও রয়েছেন।

লাইব্রেরিটিতে মোট তিনটি কক্ষ রয়েছে। একটি কক্ষ থেকে অন্যটিতে যাওয়ার দরজা রয়েছে। মাঝের কক্ষটি অফিস। প্রত্যেক কক্ষে রয়েছে জানালা। দুটি কক্ষের ভেতরে রয়েছে টেবিল ও বেশ কিছু কাঠের আলমারি। কোনোটিতে আবার স্টিলেরও রয়েছে। আলমারিজুড়ে থরে থরে সাজানো রয়েছে বই। একেকটি ঘরে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২টি করে আলমারি রয়েছে। তার সবগুলোই বইয়ে ঠাসা।

পানিহার পাবলিক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেন দীর্ঘসময় ধরে পুরো লাইব্রেরির ইতিহাস বললেন। প্রতিষ্ঠাতা এনাতুল্লাহর বিষয়ে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এনাতুল্লাহ শিক্ষক ছিলেন। বইপ্রেমী মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি পানিহার পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’

কথার ফাঁকে তিনি ছোট্ট কাপড় দিয়ে আলমারি, টেবিল, চেয়ারের ওপরে পড়ে থাকা ধুলা পরিষ্কার করতে থাকেন। অফিস কক্ষে ঢুকতেই প্রথমে ডানের ঘরে ও পরে বামের ঘরের আলমারি খুলে বই দেখালেন তিনি। কী কী বই আছে, আর কার লেখা বই একে একে বলছিলেন তিনি।

তখনও তিনি খেয়াল করেননি বইয়ে উই পোকা আক্রমণ করেছে। বামের ঘরে ঢুকে আলমারি খুললেন তিনি। সেখান থেকে বইগুলোর বিষয়ে বলছিলেন আর বইগুলো বের করে দেখাচ্ছিলেন। এক ও দুই নম্বর তাক দেখানো শেষ।

তিন নম্বর তাক থেকে একটি বই টানতে দেখা মেলে উই পোকার। এরপর নিচের তাকেও দেখা যায় একই অবস্থা। দ্রুত বই সরিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলেন লাইব্রেরিয়ান। 

এ সময় লাইব্রেরিয়ান মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমরা যত্ন করতে পারিনি। তাই বইগুলোতে উই পোকা লেগেছে। এত বছরের পুরোনো সংগ্রহ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। দেখুন এখানে এমনও বই আছে, যেটা আপনি আর কোথাও খুঁজে পাবেন না। কিনে পাওয়া তো দূরের কথা।

তিনি আরো বলেন, ‘উই পোকা এমনই, আপনি ওপর থেকে বই দেখে বুঝতে পারবেন না। তবে ভেতরে সব কিছু খেয়ে নিয়েছে। এই রুমগুলো পাকা। তারপরও উই পোকার আক্রমণ হয়েছে। কীভাবে সংরক্ষণ করব এত বই?

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠাতা এনাতুল্লাহ মাস্টার প্রায় ৭৭ বছর আগে বাড়ির পাশে দুই শতক জমির ওপর গড়ে তোলেন এই লাইব্রেরি। প্রথম অবস্থায় অল্প কিছু বই ছিল। আর লাইব্রেরিটি একটি মাটির ঘরে ছিল। ছিল না বই রাখার তেমন কিছু।

পরে এমন ভালো উদ্যোগ দেখে অনেকেই এগিয়ে আসেন। তারা বই ছাড়াও বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। লাইব্রেরির একটি কক্ষের আলমারিতে আজও সিঁদুরের ফোঁটা লেগে আছে। এতে বুঝতে বাকি থাকে না আলমারিটি সনাতন ধর্মালম্বী কারও দেওয়া।

আলমারির বিষয়টি সহজে স্বীকার করলেন লাইব্রেরিয়ান নিজেও। তিনিও বললেন, আলমারিটি সনাতন ধর্মালম্বীর কেউ দিয়েছেন। পানিহার পাবলিক লাইব্রেরিতে বিভিন্ন সাময়িকী, উপন্যাস, গল্প, সিনেমা, নাটক, অনুবাদ, ধর্ম-বিজ্ঞান, কবিতার বই, গল্পের বই, গোয়েন্দা উপন্যাস এবং উদ্ভিদ ও জীববিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৭ হাজার ৭০২টি বই রয়েছে।

পাঠকদের জন্য আছে চারটি টেবিল ও ১৮ থেকে ২০টি চেয়ার। করোনার আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ জন পাঠক আসতেন। এখন অল্প পাঠক আসে। তবে দুর্লভ বইয়ের টানে এখনও অনেক কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকরা ছুটে আসেন এখানে। 

লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্দীন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও আবুল মনসুর আহমদ, হুমায়ূন আহমেদের বই আছে। রয়েছে কলকাতার রজনীকান্তের শনিবারের চিঠি, মাসিক মোহাম্মদী, মাহেনও, জয়তী, নতুন দিন, জয় বাংলাসহ অনেক সাময়িকী।

লাইব্রেরি পরিদর্শন করেছেন যারা, মন্ত্রী প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, পল্লীকবি জসিম উদ্দীন, কবি বন্দে আলী মিয়া ও উত্তর বাংলার চারণকবি আব্দুল মান্নানসহ আরও অনেক গুণী ব্যক্তি এই লাইব্রেরি পরিদর্শন করেছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানে আলম বলেন, পানিহার লাইব্রেরির বিষয়ে অবগত হয়েছি। পাবলিক লাইব্রেরি বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ হবিবুর রহমান বলেন, ‘বই আলো-জ্ঞান বিকাশের উৎস। একটি ভালো ভবন নির্মাণ করতে আর কয় টাকা লাগে? আমার মনে হয় স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী চাইলে হয়ে যাবে। সবার আগে বইগুলো হেফাজতে নেওয়া দরকার। এত পুরোনো বই আর পাওয়া যাবে না। সেজন্য আর্কাইভ করা উচিৎ। স্ক্যান করেও বইগুলো সংরক্ষণ করা যায়।’

রাজশাহী বিভাগীয় সরকারি গণগন্থাগারের সহকারী পরিচালক মাসুদ রানা জানান, ‘পানিহার খুব সমৃদ্ধ ও অনেক পুরোনো লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির নিবন্ধন নেয়। নিবন্ধন থাকলে প্রতি বছর নভেম্বর মাসে সরকারি একটি অনুদান পেতে। তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।’
এআরএস