দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। আলোচিত জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তের পর এবার দলটির রাজনৈতিক স্বীকৃতি তথা নিবন্ধন বাতিল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ সোমবার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠকে বসবে ইসি।
গতকাল রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ‘সরকারের সিদ্ধান্তের গেজেট প্রকাশ হলেই আমরা বৈঠকে বসব। নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতেই নেয়া হবে।’
সিইসি আরও বলেন, ‘আইন অনুযায়ী, সরকার কোনো দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শুধু নিবন্ধন বাতিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত একমাত্র সরকারের এখতিয়ার।’ গত শনিবার এক জরুরি বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তাদের অঙ্গসংগঠন এবং সমর্থক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও অনলাইন কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সাম্প্রতিক সংশোধনী। এই সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল এখন রাজনৈতিক দল ও তাদের সংশ্লিষ্টদের বিচার করে শাস্তি দিতে পারবে। উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় এই সংশোধনী অনুমোদনের পাশাপাশি নিরাপত্তাজনিত কারণে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বিশেষ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা, দেশের সার্বভৌমত্ব ও শান্তি বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি ও অন্যান্য সংগঠনের টানা দুই দিনের আন্দোলনের ফলে রাজনৈতিক উত্তেজনা দ্রুত তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলনকারীরা দাবি করে, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এই দাবির প্রেক্ষিতে জনগণের চাপ ও প্রমাণের ভিত্তিতে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে-নিবন্ধন বাতিলের প্রক্রিয়া কীভাবে এগোবে?
নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম যদি সরকারের ঘোষণার মাধ্যমে নিষিদ্ধ হয়, তবে কমিশন সেই দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। তবে এটি কোনো একক সিদ্ধান্ত নয়; কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সম্মতিতেই এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে।
সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘গেজেট পেলেই আমরা প্রস্তুত। এটা নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা।’ এই পদক্ষেপকে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে এটি হতে পারে প্রথমবার, যেখানে ক্ষমতাসীন বা সাবেক ক্ষমতাধর একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনিভাবে বাতিলের পথে। তবে অনেকের প্রশ্ন, এই পদক্ষেপ দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে? কেউ বলছেন, এটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম পদক্ষেপ, আবার কেউ শঙ্কা করছেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও উত্তেজনার নতুন চক্রে ঢুকে পড়তে পারে দেশ।