মেলান্দহে প্রকল্পের অতি দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দের ৫ কোটি টাকা লুটপাট

মো. ইমরান মাহমুদ, মেলান্দহ (জামালপুর) প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৪, ০৪:০৯ পিএম

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজ শ্রমিক ছাড়াই কাগজ কলমে হাজিরা দেখিয়ে শেষ হয়েছে। এ প্রকল্প তালিকায় ভুয়া শ্রমিকদের নাম নিবন্ধন করায় প্রতিটি প্রকল্পের কাজে কাগজে কলমে কর্মসূচির শ্রমিক থাকলেও সিংহভাগ শ্রমিক মাঠে নেই।

শ্রমিকদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সমুদয় টাকা লুটপাটের জন্য শ্রমিকের বদলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ট্রাক্টরে আবার কোথাও ভেকু মেশিনে দায়সারাভাবে মাটি কেটে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রকল্প এলাকায় প্রকল্পের তথ্য সংবলিত সাইনবোর্ড থাকার কথা থাকলেও ইউনিয়নের কোথাও প্রকল্পের কোন সাইনবোর্ড লক্ষ করা যায়নি। এছাড়া কয়েকটি প্রকল্প বার বার তালিকাভুক্ত করা হলেও সে প্রকল্পের রাস্তাগুলোও ঠিকমতো মেরামত হয়নি। এসব প্রকল্প কাজে নয়, কাগজের মাধ্যমে নয়-ছয় করে প্রকল্পের অর্থ সংশ্লিষ্টরা হরিলুট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দুঃস্থ পরিবারগুলোর দারিদ্র নিরসন ও দুর্যোগে ঝুঁকিহ্রাসে সক্ষমতা বৃদ্ধিই এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য থাকলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে এই কর্মসূচির লক্ষ্য উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সময়োচিত বাস্তবায়ন না হওয়ায় যেমন সুফল পাচ্ছেন না অতিদরিদ্র শ্রমিকরা, ঠিক তেমনি সরকারের ইজিপিপি কর্মসূচির আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে সঠিক তদারকিও করছে না।

প্রকল্প এলাকায় নামে মাত্র কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে কাজ করালেও কাগজে কলমে দেখানো হচ্ছে শতভাগ হাজিরা। এভাবে নিয়মানুযায়ী কাজ না হলেও প্রকল্পের বিল পাশ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের যোগসাজশেই দুর্নীতির এমন মহোৎসব চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মেলান্দহ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১১ ইউনিয়নে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের অতি দরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (১ম পর্যায়ের) ২৬৯টি প্রকল্পে ৪০ দিনের এই কর্মসূচিতে দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরিতে ২ হাজার ৮৮৪ জন অতিদরিদ্র নারী-পুরুষ শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ ৪ কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

প্রকল্পগুলোর তালিকা মোতাবেক ৭ নং প্রকল্পে উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের বানিয়াবাড়ী মিঞাবাড়ী কবরস্থান পরিচ্ছকরণ, ১০ নং প্রকল্প নাংলার ভলগা বাজার পরিচ্ছন্নকরণ ও ৪১ নং প্রকল্প চরবানীপাকুরিয়ার চরবানীপাকুরিয়া ইউনিয়নের ভাবকি বড় বাড়ির সামনে থেকে আলাল মেম্বারের বাড়ি হয়ে পাকা রাস্তা পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের ২০২২-২৩ অর্থ বছরেও ছিল যা ২০২৪-২৪ অর্থবছরেও বরাদ্দ দেওয়া হলেও মেরামত লক্ষ্য করা যায়নি।  

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিযোগ, গায়েবি নাম উল্লেখ করে তৈরি করা হচ্ছে এসব প্রকল্প। আর এসব প্রকল্পের কাগজপত্রে শ্রমিকদের নাম তালিকাসহ অন্যান্য সব প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ থাকলেও সরেজমিনে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ও অসাধ্য বটে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকরাও জানে না তারা এ প্রকল্পের কাগজপত্রে শ্রমিক। কারণ শ্রমিকের বদলে এসব প্রকল্পে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ট্রলি গাড়ি ও ভেকু মেশিন দিয়ে প্রকল্পের দায়সারাভাবে নামমাত্র মাটি কাটে। তারা কোন শ্রমিককে কাজ করতে দেখেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় একই চিত্র উপজেলার সিংহভাগ প্রকল্পের। 
এ বিষয়ে চরবানীপাকুরিয়া ইউনিয়নের ৭ নং প্রকল্প ভাবকি বড় বাড়ির সামনে থেকে আলাল মেম্বারের বাড়ি হয়ে পাকা রাস্তা পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের সভাপতি ইউপি সদস্য আলালের কাছে একই রাস্তার কাজ দু’বার করেও রাস্তায় কেনো কোনো মাটি কাটা হয়নি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন, সভাপতি আমি হলেও সব নিয়ন্ত্রণ করে চেয়ারম্যান। প্রটোকল অনুযায়ী সভাপতি থাকতে হয় এজন্য দিয়েছে সভাপতি।’

এ বিষয়ে মুঠোফোনে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদত ভুট্টোর কাছে জানতে চাইলে তিনি সালিশে আছেন, এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন।

এদিকে ১১ নং শ্যামপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ও ৬৯ নং প্রকল্পের সভাপতি শাহাজাহানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, তিনি যে প্রকল্পের সভাপতি সেটা জানেন না। চেয়ারম্যান তার থেকে আগেই সই নিয়ে রেখে প্রকল্পের সভাপতি করেছেন। চেয়ারম্যান নিজেই প্রকল্পের কাজ তদারকি করেছে।

এ ব্যাপারে উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম সায়েদুল ইসলাম জানান, এসব কাজ মেম্বারদের দেখভালের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যান তিনি। আবারো জানতে চাইলে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করে সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।

কুলিয়া ইউনিয়নের এক প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য (মহিলা) কামরুন্নাহার বলেন, যেই মাটি কেটেছি দেখে আপনারা অজ্ঞান হবেন। কত সাংবাদিকের নিকট সাক্ষাৎকার দিলাম। কাজ দেখে তারা প্রশংসা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্যের সাথে বাস্তবের কোন মিল পাওয়া যায়নি।

মেলান্দহ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আ. রাজ্জাক বলেন, তার সকল প্রকল্প দেখা হয়নি। অফিসের অনেকেই প্রকল্প দেখেছেন। তিনি চিকিৎসার জন্য ছুটিতে ছিলেন। ছুটি শেষে এখন দায়িত্ব নিয়েছেন। একই প্রকল্প পরপর দুই অর্থবছরে থাকার বিষয়ে জানান বন্যা কবলিত এলাকায় একই প্রকল্প টানা দুই বছর থাকতে পারে। কোথাও কোন ধরনের অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবা হক বলেন, ইজিপিপি কি আমি নতুন এসেছি এটা নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না, নতুন এসেছি কয়েকদিন মাত্র হয়েছে। আমি কাজগুলো দেখতেছি কোথায় কি কাজ হচ্ছে, তারপর আমি বলতে পারবো।

ইএইচ