মানুষের জীবনে নানা চড়াই-উৎরাই আসে। কেউ দুঃখ-কষ্টে ভেঙে পড়ে, আবার কেউ সেসব প্রতিকূলতাকেই শক্তিতে রূপান্তরিত করে ইতিহাস রচনা করে। তেমনই একজন মানুষ আবু জাফর। বয়স ৬৮ বছর।
তিনি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার উত্তর মগধরা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সাকির পাঠ ওয়ারী গ্রামের বাসিন্দা। তার জীবনের গল্প প্রমাণ করে—ইচ্ছাশক্তি ও অটল নিষ্ঠার কাছে কোনো প্রতিকূলতাই বড় নয়।
মাত্র প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালীন, ১৯৬৫ সালে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একটি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার ডান হাত মারাত্মকভাবে ভেঙে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে সেই হাত কেটে ফেলতে বাধ্য হয় পরিবার। জীবনের এতটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও দমে যাননি তিনি। বরং এই সীমাবদ্ধতাই তাঁকে গড়ে তোলে মানসিকভাবে আরও দৃঢ় ও অনমনীয় এক মানুষে।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে হরিশপুর টাউন থানার সামনে ছোট একটি দোকানে পান, বিড়ি ও সিগারেট বিক্রি করে জীবিকা শুরু করেন। পরে ১৯৭৫ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে নিজ এলাকায় রহমতপুর পোলঘাটে একটি পাইকারি মুদি দোকান স্থাপন করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সংসার চালানোর বাস্তব পথচলা।
১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙন তাঁর জীবনে বড় ধাক্কা বয়ে আনে। প্রায় পাঁচ লাখ টাকার সম্পদ হারান তিনি। ভিটেমাটি হারিয়ে বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে চলে আসেন গুপ্তছড়া বাজারে। নতুন করে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা—যা আজও তাঁর একমাত্র জীবিকার উৎস।
আবু জাফরের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন তাঁর গড়ে তোলা শিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল পরিবার। তাঁর বড় ছেলে মাস্টার্স পাস করে নিউট্যাক্স কমার্শিয়াল কোম্পানিতে ম্যানেজার, দ্বিতীয় ছেলে মাস্টার্স শেষ করে তিব্বত কোম্পানিতে অডিট অফিসার হিসেবে কর্মরত। বড় মেয়ে বিএ পাস করে গৃহিণী, স্বামী একজন স্কুলশিক্ষক। দ্বিতীয় মেয়ে বিএ পাস করে প্রবাসী স্বামীর সংসার দেখছেন। তৃতীয় মেয়ে বিএ পাস করে বর্তমানে বাড়িতে আছেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো—চরম দারিদ্র্য ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও আবু জাফর কখনো কারও কাছে হাত পাতেননি। কোনো সরকারি অনুদান, প্রতিবন্ধী ভাতা কিংবা এনজিওর সহায়তা ছাড়াই শুধুমাত্র নিজের এক হাতে, পরিশ্রম ও অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ।
একটি হাত না থাকলেও ৫৩ বছরের টানা জীবনসংগ্রাম চালিয়ে আবু জাফর যে সফলতার গল্প লিখেছেন, তা নিঃসন্দেহে আজকের ও আগামী প্রজন্মের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা। তিনি শুধু সফল পিতা বা ব্যবসায়ীই নন, বরং এক জীবন্ত প্রেরণার নাম, যাঁর জীবন আমাদের শেখায়—ইচ্ছা থাকলে মানুষ যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারে।
ইএইচ