সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর (২০২১-২০২২) শেষে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে। নানামুখী সুবিধা দিয়েও আশানুরুপ ফল পাওয়া যায়নি। খেলাপির পরিমাণ কমাতে ঋণ নিয়মিত করতে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ ছাড়। ঋণের কিস্তিতে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ সুবিধা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার অনুমোদন হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
তিন মাস আগেও মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চে) বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা।
[229593]
এ বিষয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেছেন, খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না। তিনি বলেন, এখন খেলাপি ঋণ কমাতে হলে একটাই পথ, সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ এখানে এক লাখ ২৫ হাজার বলা হলেও বাস্তবে অনেক বেশি। কারণ রিশিডিউল লোন কোর্টে রিট করা ঋণসহ বেশ কিছু তথ্য যোগ হয়নি। এটি যুক্ত হলে খেলাপি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এগুলো কমাতে হলে কঠিনভাবে আইন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প উপায় নেই।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চের তুলনায় খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
[229576]
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে তাকে খেলাপি করা হয়নি। ফলে আদায় তলানিতে নামলেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। ২০২১ সালে বিশেষ সুবিধার ছাড় কিছুটা কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর খেলাপি ঋণ গিয়ে ঠেকে এক লাখ ৩ হাজার ২৩ কোটি টাকায়। এখন কিছু সুবিধা তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও গ্রাহণ ঋণ পরিশোধ করছে না। বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতারা।
সবশেষ খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ৫০০ কোটি টাকার বড় অংকের একটি মেয়াদি ঋণ চার দফায় ২৯ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে গত ১৮ জুলাই সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাপক ছাড় দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন নীতিমালা জারি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আগের নির্দেশনায় সংশোধনী আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, পুনঃতফসিল করা কোনো ঋণ ৬ মাস অনাদায়ী থাকলে তা সরাসরি ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকরণ করতে হবে। আর প্রকৃত আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে না। সবক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতার শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুনঃতফসিল করা কোনো ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে খেলাপি করলে সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
[229321]
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ বা ৫৫ হাজার ৪২৯ কোটি টাকাই খেলাপি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আলোচিত সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ০১ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলো ৬৭ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা, যা মোট প্রদান করা ঋণের ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। আলোচিত সময়ে বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এ অংক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে মোট ৩৫ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা।
ইএফ