কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা মানেই ত্যাগের মহিমা আর প্রিয়জনের সাথে মিলনের উৎসব। তবে নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা আর কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে এই ছুটির কয়েকটা দিন প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটাতে চান অনেকেই। তাই তো ঈদের লম্বা ছুটি সামনে রেখে ভ্রমণপিপাসুদের মনে উঁকি দিচ্ছে পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজ অরণ্যের হাতছানি।
দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখন থেকেই পর্যটকদের বরণে নিচ্ছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট থেকে শুরু করে পরিবহণ সংস্থা—সবখানেই এখন ঈদের অগ্রিম বুকিংয়ের ধুম।
ভ্রমণ পরিকল্পনাকারীদের পছন্দের শীর্ষে থাকা কক্সবাজার, সাজেক, সিলেট-শ্রীমঙ্গল এবং কুয়াকাটা-সুন্দরবন রুটের আকর্ষণ, প্রস্তুতি এবং সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে এবারের আয়োজন।
সাগরকন্যা কক্সবাজার: জনসমুদ্রের গর্জন
যেকোনো ছুটির দিনের জন্য পর্যটকদের প্রথম পছন্দ নিঃসন্দেহে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। বর্ষার সময় সমুদ্রের রূপ হয় আরও ভয়ংকর সুন্দর। মেঘ আর সাগরের মিতালিতে তৈরি হয় এক অপার্থিব দৃশ্য। ঈদের ছুটিতে পরিবারের সাথে নির্মল আনন্দ উপভোগের জন্য কক্সবাজারের জুড়ি মেলা ভার।
বরাবরের মতোই ঈদ পরবর্তী পর্যটনের মূল আকর্ষণ ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। ঈদের দিন বিকেল থেকেই সৈকতে মানুষের ভিড় জমতে শুরু করে, যা ছুটির দিনগুলোতে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কলাতলী, সুগন্ধা এবং লাবণী পয়েন্টে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সমুদ্রের বিশালতার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন পর্যটকেরা। কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে সৈকতে ঘুরেছেন, কেউ বিচ বাইকে গতি উপভোগ করেছেন, আবার কেউ প্রিয়জনের সাথে নোনা জলে গা ভিজিয়েছেন।
পাহাড়ের মায়া: মেঘের রাজ্যে সাজেক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম
যারা সমুদ্রের চেয়ে পাহাড়ের নির্জনতা ও সবুজ বেশি ভালোবাসেন, তাদের জন্য সেরা পছন্দ হতে পারে 'মেঘের রাজ্য' সাজেক ভ্যালি। রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও যাতায়াতের সহজ পথ খাগড়াছড়ি হয়ে। বর্ষায় সাজেকের রূপ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। চোখের সামনে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো আর হঠাৎ বৃষ্টি—এই অভিজ্ঞতা পেতে প্রতি বছর হাজারো পর্যটক ছুটে যান সেখানে।
যারা সমুদ্রের গর্জন এড়িয়ে পাহাড়ের নিস্তব্ধতা আর মেঘের ভেলায় গা ভাসাতে চেয়েছিলেন, তাদের গন্তব্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিশেষ করে 'মেঘের রাজ্য' খ্যাত সাজেক ভ্যালিতে ছিল পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়ার কটেজগুলো ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সকালের মেঘের সমুদ্র এবং বিকেলের সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন ভ্রমণপিপাসুরা।
রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ জল আর বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল ও স্বর্ণমন্দিরও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। কাপ্তাই লেকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো এবং পাহাড়ি ঝরনার শীতল পানিতে গা ভেজানোর অভিজ্ঞতা পর্যটকদের দিয়েছে এক ভিন্নধর্মী প্রশান্তি।
সবুজের হাতছানি: সিলেট ও শ্রীমঙ্গল
বৃষ্টিভেজা চা বাগান, পূর্ণযৌবনা ঝর্ণা আর হাওরের অথৈ জল—এই সবকিছুর মিশেলে সিলেট বিভাগ ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক অসাধারণ প্যাকেজ। বিশেষ করে বর্ষাকালে সিলেটের রূপ যেন উপচে পড়ে। যারা প্রকৃতিকে তার সবচেয়ে সতেজ রূপে দেখতে চান, তাদের জন্য সিলেট ও শ্রীমঙ্গল আদর্শ গন্তব্য।
পাহাড় আর সমুদ্রের বাইরে যাদের পছন্দ সবুজের সমারোহ, তারা ছুটে গেছেন সিলেট বিভাগে। শ্রীমঙ্গলের চাবাগান, জাফলংয়ের স্বচ্ছ পানি আর পাথরের বিছানা, রাতারগুলের সোয়াম্প ফরেস্ট এবং বিছানাকান্দির অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে। নৌকায় করে রাতারগুলের বনের ভেতর ঘুরে বেড়ানো কিংবা জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর হিমশীতল পানিতে পা ডুবিয়ে রাখা ছিল পর্যটকদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
তবে অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে জাফলং, বিছানাকান্দি এবং সাদাপাথরের মতো স্থানগুলোতে কিছুটা অব্যবস্থাপনাও চোখে পড়েছে। নৌকার ভাড়া এবং খাবারের দাম নিয়ে অনেক পর্যটকের অভিযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে এসব ছোটখাটো সমস্যাকে তারা তেমন গুরুত্ব দেননি।
অন্যান্য গন্তব্য: কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন
যারা সমুদ্র ও বন উভয়ই উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন হতে পারে সেরা ঠিকানা। পদ্মা সেতুর কল্যাণে ঢাকা থেকে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক সহজ ও আরামদায়ক।
জনপ্রিয় এই স্থানগুলো ছাড়াও সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটাতেও ছিল পর্যটকদের ভিড়। একই সৈকত থেকে সূর্য ওঠা এবং ডোবার বিরল দৃশ্য উপভোগ করতে বহু মানুষ সেখানে ভিড় জমিয়েছেন। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতেও পর্যটকদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। লঞ্চ ও ছোট ছোট বোটে করে করমজল, হাড়বাড়িয়া ও কটকার মতো স্পটগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পর্যটকরা।
অর্থনীতির চাকা সচল, তবে চ্যালেঞ্জও প্রচুর
ঈদ পরবর্তী এই পর্যটনের জোয়ার দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহণ খাত এবং স্থানীয়দের মুখে হাসি ফুটেছে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এর এক কর্মকর্তার মতে, এই এক সপ্তাহে পর্যটন খাতে কয়েকশ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, যা করোনা পরবর্তী সময়ে এই শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো। বেশ কিছু স্থানে দেখা গেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে হোটেল ভাড়া ও খাবারের দাম বাড়ানোর প্রবণতা। কক্সবাজার ও সাজেকের মতো জায়গায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি দামে হোটেল ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন পর্যটকরা।
পরিবেশগত ঝুঁকিও একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৈকত, পাহাড় এবং বনাঞ্চলে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট এবং অন্যান্য আবর্জনার স্তূপ জমেছে। অনেক পর্যটকের মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হুমকির মুখে পড়ছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ডাস্টবিন এবং কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রে ট্যুরিস্ট পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন তৎপর ছিল। কক্সবাজার সৈকতে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য ওয়াচ টাওয়ার এবং বিচ কর্মীদের মোতায়েন করা হয়। সাজেক ও বান্দরবানে যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই পর্যটকরা ভ্রমণ উপভোগ করতে পেরেছেন।
ঈদ পরবর্তী ভ্রমণ এখন বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করে নতুন উদ্যমে কাজে ফেরার জন্য এই ভ্রমণ এক মহৌষধের মতো কাজ করে। এটি একদিকে যেমন পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করে, তেমনই দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখে। তবে এই বিপুল সংখ্যক পর্যটকের চাপ সামলানোর জন্য প্রয়োজন টেকসই পর্যটন পরিকল্পনা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং পর্যটকদের সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রেখে যদি পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আরও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যায়, তবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প ভবিষ্যতে আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে। আপাতত, প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটানো এই কয়েক দিনের স্মৃতি নিয়েই শহরমুখী হচ্ছে ঘরছাড়া মানুষেরা, চোখে-মুখে একরাশ প্রশান্তি আর নতুন করে পথচলার প্রত্যয়।
ইএইচ