দেশে অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের প্রবণতা বাড়ছে?

ডয়চে ভেলে বাংলা প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২২, ০১:১৭ এএম

প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শনের বেশ কয়েকটি ঘটনা গত কিছুদিনে গণমাধ্যমের খবরে এসেছে৷ কিন্তু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান কি হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে? বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র এবং অস্ত্র প্রদর্শনের প্রবণতা কি বাড়ছে?

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদারের ওপর হামলার পর ওই ইউনিয়নের যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান জুয়েলের অস্ত্র নিয়ে উল্লাসের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে৷ ছবিতে দেখা যায়, অভিযুক্ত মনিরুজ্জামান জুয়েল মিয়াবাজার গ্রিন ভিউ রেস্টুরেন্টের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র একহাতে নিয়ে আরেকহাতে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে উল্লাস করছেন৷ এর আগে গত মে মাসে আবু বক্কর সিদ্দিকী রাতুল নামে পাবনার সুজানগর উপজেলা ছাত্রলীগের এক নেতা অস্ত্র হাতে ছবি সামাজিক মাধ্যমে দেন৷ মুহুর্তেই সেই ছবি ভাইরাল হয়৷

এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর নিউমার্কেটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেসব জায়গায় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, প্রায় সব জায়গাতেই অস্ত্রের দেখা মিলেছে৷ ফলে অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের একটা প্রবণতা ধীরে ধীরে যেন প্রকট হয়ে উঠছে৷

কিন্তু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কোনো অভিযানের  খবর বেশ কিছুদিনে দেখা যায়নি৷ তবে এ বিষয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে৷ পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে এখন দেশের প্রতিটি জায়গায় প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে অস্ত্রবিরোধী বিশেষ অভিযান চালানো হয়৷ কয়েকটি ঘটনায় অস্ত্রের প্রদর্শন হয়েছে সত্যি, তারা তো গ্রেপ্তারও হয়েছে৷ কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে, অবৈধ অস্ত্র বাড়লে সেটার ব্যবহারও বাড়বে৷ কিন্তু গত চার মাসে রাজধানীতে গুলিতে একজন আওয়ামী লীগ নেতা খুন হওয়া ছাড়া আর কোথাও অস্ত্রের ব্যবহার হয়নি৷ আমরা প্রতি মাসেই রাজধানী থেকে ৩-৪টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করি৷ কখনো সেটা ৫-৬টিও হয়৷”

কুমিল্লার যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান জুয়েল এখনও গ্রেপ্তার না হলেও পাবনার ছাত্রলীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দিকী রাতুল র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে৷ তার সেই অস্ত্রও উদ্ধার করেছে র‌্যাব৷ কেন তিনি অস্ত্র হাতে ফেসবুকে ছবি দিয়েছিলেন? সাংবাদিকদের রাতুল বলেছিলেন, ‘‘আমার কাছে যে একটা অস্ত্র আছে, সেটা এলাকার সবাইকে দেখানোর জন্যই ফেসবুকে ছবি দিয়েছি, যাতে এলাকার লোকজন আমাকে ভয় পায় এবং আমার কথা শুনে চলে৷”

অস্ত্রের এমন প্রদর্শনের কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌহিদুল হক বলেন, ‘‘অস্ত্রের এই প্রদর্শন আমাদের তিনটি বার্তা দেয়৷ প্রথমত, এই অবৈধ অস্ত্র যারা সংগ্রহ করেন বা রাখেন, তাদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো-না-কোনো সদস্যের একটা সখ্য আছে৷ সেই সখ্যের ভিত্তিতেই তারা এই সাহসটা পায়৷ গণমাধ্যমে অস্ত্রসহ ছবি ছাপা হওয়ার পরও তাদের মধ্যে কোনো ধরনের অপরাধবোধ বা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়ার লক্ষণ আমরা দেখতে পাই না৷ দ্বিতীয়ত, অস্ত্র প্রদর্শন করে কেউ যখন নিজের বীরত্ব প্রকাশ করতে চায়, তখন বুঝতে হবে সমাজে এদের প্রভাব বেড়ে গেছে৷ তারাই সমাজের চালিকা শক্তি৷ সেখানে সাধারণ মানুষের গুরুত্ব কম৷ আর তৃতীয়ত, আগে আমরা দেখতাম এই ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠতে৷ এখন সেটা দেখা যায় না৷ কেউ প্রতিবাদ করেন না৷ কারণ, এদের সবাই ভয় পায়৷ ফলে সাধারণ মানুষ একটা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে দিন পার করছেন৷”

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর নিউমার্কেটে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের সময় যে অস্ত্রের ছবি সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে এসেছে সেগুলো উদ্ধার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ অস্ত্রধারী সেই নেতাদের অনেককে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি৷''

গত জানুয়ারি মাসে শেষ হওয়া ৬ ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় মারা গেছেন ৯৫ জন৷ সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে৷ এই দুই ধাপে যথাক্রমে ৩০ ও ২৬ জন নিহত হয়েছেন৷ প্রথম ধাপে দুই ভাগে নির্বাচন হয়েছে৷ দ্বিতীয় ভাগের নির্বাচন হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে৷ মূলত তখন থেকেই সারা দেশে নির্বাচন ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয়৷ প্রথম ধাপে ৫ জন, চতুর্থ ধাপে ১০, পঞ্চম ধাপে ২৩ ও ষষ্ঠ ধাপের সহিংসতায় একজনের মৃত্যু হয়েছে৷ এই সহিংসতার ঘটনাগুলোতেও অবৈধ অস্ত্রের প্রদর্শন হয়েছে৷ কিন্তু নির্বাচনের আগে-পরে অবৈধ অস্ত্র বিরোধী বিশেষ কোনো অভিযান দেখা যায়নি৷

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-র দেওয়া তথ্য মতে, গত ১০ বছরে এসএমজি, রাইফেল, রিভলবার, পিস্তল, বন্দুকসহ সীমান্ত পেরিয়ে দেশে প্রবেশের সময় অন্তত দেড় হাজার আস্ত্র তারা উদ্ধার করেছে৷ র‌্যাবের অভিযানে শুধু ২০২১ সালেই দেশি-বিদেশি ৮৪৪টি অস্ত্র, ১৭৯টি ম্যাগাজিন, ৬ হাজার ৮৫৯ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১২ হাজার ২৮টি বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে৷ যেসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তার বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা৷

র‌্যাব ও পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, র‌্যাব ও পুলিশ বছরে গড়ে দুশ'টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে৷ বিজিবির হাতে গড়ে দেড় শতাধিক অস্ত্র ধরা পড়ে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অন্তত তিনগুণ, অর্থাৎ বছরে এক হাজারেও বেশি অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে৷ এই বিপুল পরিমান অস্ত্র কোথায় ব্যবহার হয় জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অবৈধ অস্ত্র মূলত দু'টি জায়গায় ব্যবহৃত হয়৷ প্রথমত, সন্ত্রাসীরা

হত্যা, চাঁদাবাজি, লুটতরাজের কাজে ব্যবহার করে৷ আর দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অঙ্গনে৷ সেখানেও সংঘাতের সময় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়৷ সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ ফলে এখন অবৈধ অস্ত্র পরিমানে একটু বেশীই আসবে বলে আমরা ধারণা করছি৷”

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘‘অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি নিয়মিত কাজ৷ বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কেমন তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই৷ তবে উদ্ধার অভিযান থেকে ধারণা করা যায়, এখানে অবৈধ অস্ত্র আছে৷ অবৈধ অস্ত্রবিরোধী বিশেষ অভিযান বিশেষ বিশেষ সময়ই চালানো হয়৷ অন্য সময় ব্লক রেইড বা বিকল্প অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়৷ মিয়ানমার সীমান্তে কিছু অবৈধ ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের তথ্য জানা যায়৷ কিন্তু সর্বিকভাবে দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পর্যায়ে গেছে বলে আমার মনে হয় না৷”

ইএফ