ব্যাংক চেক ছাড়া মেলেনা ক্ষুদ্র ঋণ

মামলার ফাঁদে গ্রামীণ নারীরা

শরিফ রুবেল প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৩, ০৫:৩৪ পিএম
  • ঋণ আদায়ে আইন নেই বাড়ছে যথেচ্ছ ব্যবহার
  • উচ্চ আদালতের আদেশ মানছেনা এনজিও 
  •  ব্যাংক চেক সম্পর্কে অজ্ঞতায় ফেঁসে যাচ্ছেন নারীরা
  • ঋণের বিপরিতে চেক জমা নেয়া অবধৈ মত আইনজ্ঞদের
  • চেকের মামলায় ৪৭২ কয়েদির মধ্যে ১৪ জনই নারী
     

নুরজাহান খাতুন। মেহেরপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা। সুজনী ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। চার মাস কি¯িত্মও পরিশোধ করেন। তবে পারিবারিক সমস্যায় দুই মাস কি¯িত্ম পরিশোধ করতে পারেননি। বিপত্তি ঘটে এখানেই। ঋণ নেয়ার সময় এনজিও’তে জমা দেয়া চেক ডিজঅনার দেখিয়ে মামলা ঠুকে দেন সুজনী ফাউন্ডেশন। মামলা নং সিআর ৫১৬/২২। একই মামলায় ও একই অপরাধে আসামি করা হয় আরো ৬ নারীকে। পরে আদালত গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করলে সদর থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেন কারাগারে পাঠান। সেই থেকে নুরজাহান জেলে আছেন। জামিনও মিলছে না। আইন অনুয়ায়ী ডিজঅনার হওয়া চেকের অর্ধেক টাকা জমা দিলেই জামিন। না হলে নেই। টাকা জমা না দিলে জেলেই থাকতে হবে। আরেকজন জমিলা বেগম। অভাব অনটনের সংসার। ভিটেমাটি নেই। বাড়ি কুড়িগ্রামের চর ভূরম্নঙ্গামারী। স্বল্প শিক্ষিত জমিলা স্বামীর একাšত্ম অনুগত ছিলেন। স্বামী স্থানীয় এক এনজিও থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে জামানত হিসাবে এনজিও’কে স্ত্রীর নামে ইস্যুকৃত ৫ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন। তবে ঋণ নেয়ার পরে কি¯িত্ম না দিয়েই টাকা নিয়ে ঢাকায় পালিয়েছেন স্বামী। এতইে চরম বিপদে পড়েছেন জমিলা। কি¯িত্ম পরিশোধ না করায় এনজিও চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা দিয়েছেন। মামলার পড়ে এখন বাড়িঘর ছেড়ে সšত্মান নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু জমিলা ও নুরজাহানই নয় এনজিওর ঋণের ফাঁদে পড়ে দিশেহারা হচ্ছেন অনেক নারী। মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা। ঋণ নিতে গেলেই নরীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ফাঁকা ব্যাংক চেক। কি¯িত্ম পরিশোধে হেরফের হলেই জমা নেয়া চেক ডিজঅনার দেখিয়ে মামলা ঢুকে দেয়া হচ্ছে। কারাবরন থেকে বাঁচতে টাকা পরিশোধ করেও অনেকের মামলার ঘানি থেকে নি¯ত্মার মিলছে না। মামলা চলছে বছরের পর বছর। অযাথা মামলা চালিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন গ্রামীন নরীরা। অথচ কোন এনজিও চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে না উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনাও রয়েছে। তবুও মানছে না।

জানা গেছে, গত ২৮ নভেম্বর এনজিওর দায়ের করা চেক ডিজঅনার মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এছাড়া ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে কোনো এনজিও যদি তা আদায়ে চেক ডিজঅনার মামলা করে তাহলে তা সরাসরি খারিজ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালত বলেন, এখন থেকে কোন এনজিও চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে না। এনজিও গুলো বেআইনিভাবে ঋণ আদায়ের জন্য চেক ডিজঅনার মামলা করে আসছে। ক্ষুদ্র ঋণ আদায়ের জন্য তাদের কোন আইনই নেই। তারা একমাত্র দেওয়ানি আদালতে অর্থ আদায়ের জন্য মোকাদ্দমা দায়ের করতে পারে। আদালত বলেন, এনজিও গুলো দাদন ব্যবসায়ীর মত আচরণ করছে। তারা গরীব মানুষের জীবনমান উন্নয়নের নামে জীবন বিধ্বংসী কার্যক্রম করছে। গরীব-দু:খী মানুষকে জেলে ভরছে। এটা কাম্য হতে পারে না।

কোন বিধিবিধান ও নীতিমালা ছাড়াই এনজিওগুলো নিজের খেয়ালখুশিমত তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ঋণ নিতে গেলেই নেয়া হচ্ছে ফাঁকা চেক। ব্যাংক চেক না দিলে ঋণও দিচ্ছে না। কি¯িত্ম না দিলেই ইচ্ছামত দেয়া হচ্ছে মামলা। মামলার আসামি করা হচ্ছে পরিবারের একাধিক সদস্যকে। চেকের মামলায় প্রায়ই কারাগারে যাচ্ছে অসহায় ভুক্তভোগীরা। অনেকে মামলা চালিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। দেশে বর্তমানে নারী আসামির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

বেশকিছু মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব মামলায় জড়ানোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর কোনো ভূমিকা নেই। অথচ মামলার আসামি হয়েছেন। গেছেন জেল হাজতেও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নারী পুরম্নষ দুজনেই সুবিধাভোগী অথচ মামলার জালে আটকা পড়ছে শুধুই নারী। আর এই মামলাগুলোর অধিকাংশই হল চেক ডিসঅনারের অতি সাধারণ মামলা। ঋণের টাকা ঋণ গ্রহীতা নিজে ব্যবহার করতে পারেননি বা সংসারের কাজের জন্য ব্যয় হয়েছে। তবে সেই টাকার জন্য শুধুই নারীকে মামলার ঘানি টানতে হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে স্বামী তার স্ত্রীকে ব্যবহার করে এরূপ ঋণ গ্রহণ হয়তো খুব কম। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর সংখ্যা অনেক বেশি।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের কারাসংখ্যা প্রতিবেদন অনুসারে সে সময় দেশের কারাগারগুলোতে মোট সাজাপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে চেক ডিসঅনারের কয়েদি ছিলেন ৪৭২ জন। এর মধ্যে নারী কয়েদি ছিলেন মাত্র ১৪ জন। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিনই এমন মামলা পাই। হঠাৎ করে এই বেড়ে যাওয়াটা আশঙ্কাজনক। এখনই এর লাগাম টেনে ধরার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দেশে শিগগিরই নারী কয়েদিদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে।

দেশে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষুদ্রঋণ পান নারীরা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীর পাওয়া ঋণের টাকা পুরম্নষরাই খরচ করেন। জমিলা ও নুরজাহান দুজনেই জানিয়েছেন, তারা যদি জানতো চেক ডিসঅনার হলে মামলা হয়। এবং মামলায় আসামির ১ বছরের জেল বা চেকে বর্ণিত টাকার ৩ গুণ পর্যšত্ম জরিমানা দিতে হয়। তাহলে তারা ঋণ নেয়ার সময় চেক দিতেন না। আবার আসামির সাজা হলে আইনের বিধান মোতাবেক চেকে বর্ণিত টাকার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ টাকা চালান মূলে জমা না দিলে আসামির আপিলের শর্তে জামিন বিবেচনার সুযোগ নেই। কিন্তু চেক ডিসঅনার হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞতায় অনেকে ফেঁসে যাচ্ছেন।  আবার অনেকে জেনে শুনেই ফাঁকা চেক দেয়। বাধ্য হয়েই এভাবে ঋণ নেয়। কোনো কোনো নারীর বেতনের চেক দিয়ে একাধিক জায়গায় লোন নেন। মাস শেষে শূন্য হাতে বাড়ি ফেরে এমন নজিরও আছে। অনেকে এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিওর দেনা শোধ করছে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশের তিন কোটি ৫২ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে। তাই সময়ের প্রয়োজনে এর নীতিমালার কিছু পরিবর্তন জরম্নরি। যাতে ঋণের টাকা নারীরা নিজেই খরচ করে জীবন মানের পরিবর্তন করতে পারে। এ বিষয়ে প্রত্যেকেটি সংস্থায় পৃথক মনিটরিং সেল থাকতে হবে। ঋণ দাতাকে ঋণ প্রদানের পূর্বে চেক ডিসঅনারের পরিণতি কী হবে তা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ গ্রহীতার পেশা, ঠিকানা, ঋণের ধরন, টাকার ব্যবহার এবং খেলাপি ঋণ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারিভাবে একটি লোনের ডাটাবেজ করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষুদ্র ঋণ পরীক্ষামূলকভাবে যৌথ হিসাবের বিপরীতে দেওয়া যেতে পারে।

বেশ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন গ্রামের ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক আশা,ভরসা, ব্রাক, ব্যুরো বাংলাদেশ, গ্রামীণ ব্যাংক, প্রশিকাসহ কয়েকটি এনজিও ঋণ নেয়ার পরের সপ্তাহ থেকে কি¯িত্ম আদায় শুরম্ন করে। কৃষকের জমিতে ফসল ভালো না হলে ঋণগ্রহীতাকে ঘরের গরম্ন-ছাগল, হাঁস-মুরগী, ঘটি-বাটি বিক্রি করে সাপ্তাহিক কি¯িত্ম পরিশোধ করতে হয়। যখন তাতেও কুলায় না তখন ভিটা-মাটি ও ঘর বিক্রি করতে হয়। এমনও বহু ঘটনা ঘটেছে যে কি¯িত্ম আদায়কারীরা ঋণের দায়ে ঋণ গ্রহীতার ঘর ভেঙে নিয়ে গেছে। এ বীভৎসতায় আত¥হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ঋণ নেয়ার সময় ব্যাংক চেক জমা নেয়া হয়। আর কি¯িত্ম দিতে দেরি হলেই সেই চেক ডিজঅনার দেখিয়ে মামলা দেয়া হয়। তাই মামলার ভয়ে অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করেও এনজিওর দায় পরিশোধ করেন। এনজিওর ঋণ গ্রহীতাদের অধিকাংশই ঋণের দায়ে অতিষ্ঠ। তারা এ জাল থেকে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু এনজিওগুলির কৌশলী তৎপরতায় তারা কোনভাবেই এ জাল থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।

জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, আসলে এনজিওগুলো কখনোই কোন নীতিমালা মেনে চলেন না। তারা নিজেদের স্বার্থে খেয়ালখুশি মত তাদের কার্যক্রম চালায়। গ্রামীণ প্রাšিত্মক নারীদের জীবনমান উন্নয়নের শর্তে লাইসেন্স দেয়া হলেও অনেকসময় দেখা যায় তাদের অবৈধ কার্যক্রমের জন্য নারীদের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে ব্যাংকের ড়্গুদ্র ঋণের যে আইন আছে, সেখানে চেক নিয়ে ঋণ দিতে হবে এমন কিছুৃ উলেস্নখ নেই। তারপরেও তারা এটা করে আইন ভঙ্গ করছেন। ঋণ খেলাপির জন্য চেক ডিজঅনারের মামলা দেয়া হলে সেটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। তাই বাংলাদেশে ব্যাংকের উচিত এই গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়টি মনিটরিং করা। আর যেহেতু উচ্চ আদালত গ্রাহকদের কাছ থেকে চেক গ্রহন করা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন, সেহেতু এনজিওগুলো আইনগতভাবে এসব করতে পারেন না। উচ্চ আদালতের আদেশ মানা সকলের দায়িত্ব।

এামলায় আটকে যাচ্ছে গ্রামের নারীরা এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিষ্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, এই সমস্যাটা প্রকট আকার ধারন করেছে। এনজিও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে নিঃস্ব হচ্ছেন।  গ্রাম গঞ্জের ৯০ শতাংশ ড়্গুদ্র ঋণ প্রদানকারি এনজিওই অনুমোদনহীন। তাই তাদের টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়টা সম্পূর্ণ অবৈধ। আবার তাদের কার্যক্রমও প্রতারণামূলক। অনেক সময় দেখা যায় তারা টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আবার যাদের লাইসেন্স আছে, তারাও ড়্গুদ্র ঋণের কোন নীতিমালাই অনুসরন করেন না। তাই তাদের অবিলম্বে একটা নীতিমালার মধ্যে আনা উচিত। তারা একপ্রকার দাদন ব্যবসায়ীদের মত চড়া সুদে গ্রামীণ নারীদের ঋণ দেন। যেটা পরবর্তিতে পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে যায়। তখন লোন নেয়ার সময় যে চেক জমা দেয়া হয়, পরে সেটা ডিজঅনার দেখিয়ে মামলা দেন। এটা আইনের চরম লঙ্ঘন। এ বিষয়ে ভিকটিম লাখ লাখ। তাই সরকারের উচিত গ্রামীণ নারীদের প্রতারনার হাত থেকে বাঁচাতে দ্রম্নত এ বিষয়ে প্রচার প্রচারণার উদ্যেগ নেয়া। আর লোন নেয়ার সময় চেক জমা দিতে হবে এটা তাদেও নিজস্ব তৈরি করা নিয়ম। আইনে এমন কিছু বলা নেই।

এবি