সুইডেন সরকারের গবেষণা ফেলোশিপ পেয়েছেন তিতুমীর কলেজ ছাত্র আলী আহমদ

তিতুমীর কলেজ প্রতিনিধি প্রকাশিত: মে ২, ২০২৪, ০৮:৫৭ পিএম

সরকারি তিতুমীর কলেজ রিসার্চ ক্লাবের সভাপতি ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী, আলী আহমদ সুইডেন সরকারের গবেষণা ফেলোশিপ পেয়েছেন।  International Centre for Climate Change and Development (ICCCDA) ও Independent University, Bangladesh (IUB) এর যৌথ উদ্যোগে এবং সুইডেন সরকারের অর্থায়নে "Capacity Strengthening Multi-actors to Limit Climate Change Impacts and Enhance Resilience (CAP-RES)" (জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর জন্য বহু-অভিনেতাদের দক্ষতা বৃদ্ধি) প্রকল্পের অধীনে তিনি উক্ত ফেলোশিপ পেয়েছেন। ফেলোশিপের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা। 

তার গবেষণার বিষয় হলো Climate-Smart Agriculture (CSA) . যা জলবায়ু-সমৃদ্ধ কৃষি বা জেটি কৃষি নামেও পরিচিত।

আলী আহমদ তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে দৈনিক আমার সংবাদ কে বলেন, আমার পূর্বে বাংলাদেশে কেউ আন্ডারগ্রেডে থাকা অবস্থায় গবেষণা ফেলোশিপ পেয়েছে বলে জানা নেই! এত বড় অর্জন পেয়ে এখনো কেমন যেন স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে! উক্ত ফেলোশিপ টি সাধারণত মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য দেয়া হয়ে থাকে। আমার তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে পরীক্ষা নেয়ায় সেই সময় কে কাজে লাগাতে একটি রিসার্চ ফার্মে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্টার্ন হিসেবে ৩ মাসের জন্য যুক্ত হই। সেই অভিজ্ঞতা সহ আরো প্রাসঙ্গিক কিছু কাজের কথা উল্লেখ করে আমার সিভি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলাম যে, আমি রিসার্চ প্রপোজাল জমা দিতে পারব কিনা? তারা সবকিছু বিবেচনা করে আমাকে আবেদন করতে উৎসাহিত করে। উঁচু প্রত্যাশা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আমার রিসার্চ প্রপোজাল তৈরি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিকে আমার সকল প্রতিদ্বন্দ্বী আমার সিনিয়র তথা মাস্টার্সের শিক্ষার্থী, অপরদিকে মাত্র দশ জন কে উক্ত ফেলোশিপ প্রদান করা হবে, এটা  ভেবে ভয়ের পরিধিও ছিল বেশ! তবুও ছোট্ট একটি আশা জিইয়ে রেখেছিলাম যে, দশ জনের মধ্যে আমাকে একজন হতেই হবে।

তিনি আরো বলেন, প্রথম অবস্থায় জমা দেয়ার পর প্রায় মাস খানেক সময় চলে যায়, কোন ফিডব্যাক আসেনি। তাই ফিডব্যাক বা আপডেট চেয়ে ই-মেইল করলে আরো দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু পরবর্তী ৩ সপ্তাহ অপেক্ষা করে পুনরায় ই-মেইল করলে আরো দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে বলা হয়। এভাবে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। 

গত ২৬ এপ্রিল (শুক্রবার) সকাল ৮:৩০ টার  হঠাৎ একটা ই-মেইল আসে। কিছুক্ষণ পর ই-মেইল  ওপেন করে সাবজেক্ট লাইনে "Congratulations! You‍‍`ve been selected for the Research Grant (Mentorship)2024" দেখার সাথে সাথেই হাত-পা কেঁপে উঠলো! কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না! ঠিক ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েই একাধিকবার পুরো ই-মেইল টি পড়ে এবং ICCCDA, IUB এবং Sweden Embassy এর লোগো দেখে নিশ্চিত হয়েছি যে, ই-মেইল টি ফেইক নয়। একই জায়গায় ঐ অবস্থায় দাঁড়িয়েই মা-বাবা, বড় ভাইয়া এবং প্রিয় মানুষ কে সুখবরটি জানালাম।

আলী আহমদ আরো বলেন, জীবনের লক্ষ্য চূড়ান্ত করে নিয়েছিলাম সেই উচ্চ মাধ্যমিকে থাকতেই। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমার অ্যাকাডেমিকলি সাউন্ড সহ ভালো রেজাল্ট ধারী একটি অনার্সের সার্টিফিকেট দরকার, এই বিশ্বাস টি তখন থেকেই নিজের মধ্যে জন্মাতে পেরেছিলাম। ফলে বিশেষ কোনো ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হতে না পারলেই জীবন শেষ! এসব হীনম্মন্যতা আমার মধ্যে জায়গা করতে পারে নি। বরং তখনকার ফ্যামিলি ক্রাইসিস ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে কোন ধরনের কোচিং, শিট তথা বিশেষ প্রস্তুতি ছাড়াই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় চার হাজার পজিশন পেলে আর কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দেই নি। যে করেই হোক, কেবল অর্থনীতি নিয়েই অনার্স করব, সেই প্রত্যাশা থেকে ছেলেদের ৫ টি কলেজেই ১-৫ পর্যন্ত কেবল অর্থনীতি পছন্দ দেই এবং পছন্দের তালিকার ২ নম্বরে ছিল তিতুমীর কলেজ অর্থনীতি। সেটাই আসল। 

আমি এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। আমাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান হয়েছিল ২৭ জানুয়ারি। ঐ ২৭ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি তথা ঠিক এক মাস পর্যবেক্ষণের পর তখনকার তিতুমীর কলেজের বিশেষ করে অর্থনীতি বিভাগের বাস্তবতা দেখে সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সাস্টে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন থেকেই তিতুমীর কলেজের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে সারা বছর সেকেন্ড টাইমের প্রস্তুতি নিয়েছি।পৃথিবীতে ভাগ্য বলতে আসলেই কিছু থেকে থাকলে সেটা ছিল আমার সাস্টের সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষা! সারা বছর পরিশ্রম করে পরীক্ষা হলে গিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে পরীক্ষা দিলাম ঠিকই, কিন্তু রেজি: নম্বর ভুল দিয়ে আসলাম। ভেবেছিলাম যেহেতু ভর্তি পরীক্ষার রুল নম্বর সঠিক দিয়েছি, তাহলে হয়ত রেজাল্ট চলে আসবে। কিন্তু আসে নি!

এই সময়ের মাঝে ঘটমান নানা বিষয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, এই ফেলোশিপ প্রাপ্তির সংবাদ যতটাই বেশি আনন্দের, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্টের ছিল ঐ মুহূর্ত টা! যখন সাস্টের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছিল। আমার পরিবার সবচেয়ে বেশি সাপোর্টিভ হলেও আমার জার্নি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন, সেরকম একজন মানুষও ছিলেন না! তাছাড়া কলেজে ক্লাস না করায় তেমন কোন বন্ধুও তৈরি হয়নি তখন। তাই সম্পূর্ণ একা সেই কষ্ট সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না সেদিন।

আরো কিছুদিন বাড়িতে থেকে অবশেষে পুনরায় ঢাকায় এই তিতুমীর কলেজের অর্থনীতি বিভাগেই ফিরে আসতে হলো! তবে, এবারের আসাটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এইবার আর কোন প্রত্যাশা নিয়ে আসি নি। বরং এসেছিলাম যে, ঠিক যেই সব কারণে আমি তিতুমীর কলেজ থেকে হতাশ হয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের শিক্ষা জীবন থেকে একটি বছর কে হারালাম, আমি এমন কিছু করব, যেন সেই সব কারণে আর একজন শিক্ষার্থীকেও হতাশ হতে না হয়! নিজের শিক্ষা জীবনের অমূল্য সম্পদ একটি বছর কে হারাতে না হয়! 

সেই প্রতিজ্ঞার সূত্র ধরেই ক্রমান্বয়ে তিতুমীর কলেজে প্রতিষ্ঠা করলাম ‍‍`সরকারি তিতুমীর কলেজ রিসার্চ ক্লাব, (জিটিসিআরসি)‍‍` যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে আমিই কেবল তিতুমীর কলেজে নয় বরং (খুব সম্ভবত) পুরো বাংলাদেশে উদাহরণ তৈরি করলাম যে, একজন আন্ডারগ্রেডের শিক্ষার্থী হয়েও শুধু যোগ্যতা দিয়ে দেশের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গবেষণা ফেলোশিপ নিয়ে আসা যায়।

তিতুমীর রিসার্চ ক্লাবের সভাপতি আলী আহমদ বলেন, রিসার্চ ক্লাব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে গতানুগতিক ক্যারিয়ার ভাবনার বাইরে গিয়ে চমৎকার ও অনেক ইনোভেটিভ ক্যারিয়ার ভাবনা বিশেষ করে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার প্রতি তাদের অগাধ আগ্রহ দেখেছি। কিন্তু একই সাথে গবেষণা ফান্ডিং, ল্যাব সহ আরো বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তাদের ভেঙ্গে পরতেও দেখেছি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাদেরকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে বের করে গ্লোবালি চিন্তা করানোর। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীর মাঝেই এই বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছি। তবে একেবারেই যে পারিনি তা কিন্তু নয়। 

কিন্তু এখন যেহেতু নিজেই সেই অর্জন করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছি, তাই তারাও এখন নিজেকে বিশ্বাস করে এগিয়ে যেতে পারবে। তিতুমীর কলেজ থেকেই ইনশাআল্লাহ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যাবে অনেকেই।

নিজের কাজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে গিয়ে আলী আহমদ বলেন, আমি সেই প্রথম বর্ষে থাকতে BUET এর environmental sustainability in textile industries (EStex), HOV  এবং SNV এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত Youth Water Fellowship  এর জন্য রিসার্চ প্রপোজাল জমা দিয়েছিলাম। তখন গবেষণার কিছুই জানতাম না বলা চলে। অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যমে ঘাঁটাঘাঁটি করে যা বুঝতে পেরেছিলাম, তাই লিখে জমা দিয়েছিলাম। সেটাতে রিজেক্টেড হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু খুব চমৎকার একটি ফিডব্যাক পেয়ে আরো বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। 

এরপর থেকে যখন যেখানে যেই কাজের সুযোগ পেয়েছি, সেই কাজই করেছি। অধিকাংশই সম্পূর্ণ ফ্রিতে করেছি কেবল শিখা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। গবেষণার বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক কোর্স ও কর্মশালা করেছি। সর্বশেষ গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত একটি ইন্টার্নশিপ করেছি। এটাও সম্পূর্ণ ফ্রি এবং নিজের পকেটের টাকা খরচ করে যাতায়াত সহ অন্যান্য ব্যয় বহন করেছি। 
তবে এই ফেলোশিপ পাওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি বাজিমাত করেছে আমার ঐ ৩ মাসের ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা।

সবশেষে তিনি বলেন, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ভরসার জায়গা হিসেবে তিতুমীর কলেজ রিসার্চ ক্লাবের যাত্রা শুরু করেছিলাম, যেখানেই থাকি না কেন,  ইনশাআল্লাহ সবসময়ই এর সাথে থাকব এবং তিতুমীর কলেজের যে কোন সিনিয়র-জুনিয়র, সহপাঠী বন্ধু কিংবা যে কারো কাজে লাগার সুযোগ পেলে অবশ্যই সেই সুযোগ কাজে লাগাব।

আরএস