জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবিকে কেন্দ্র করে চলমান বিতর্কের মধ্যেই নতুন করে সামনে এসেছে 'আমার সোনার বাংলা' গানটির পেছনের ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহে কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেল, তা নিয়ে উঠে এসেছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের নানা দিক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত—এমনটা বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধে উঠে এলেও গানটির মূল পাণ্ডুলিপি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কবির জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ওই গানটি প্রথম গাওয়া হয় ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায়।
এরপর একটানা ছয় দশক গানটি রবীন্দ্রসংগীত হিসেবেই পরিচিত ছিল। তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ‘আমার সোনার বাংলা’ বিভিন্ন গণআন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তানি সরকার রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গণসমাবেশ ও প্রতিবাদে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয় বারবার। ওই সময়কার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক ও সংগীতজ্ঞ সনজীদা খাতুন লিখেছেন—রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে “সাতষট্টির আন্দোলনের সবচেয়ে স্থায়ী ফসল ছিল ‘আমার সোনার বাংলা’-এর প্রতিষ্ঠা।”
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান আচমকা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। পরদিন ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে ছাত্রনেতারা বসে স্বাধীনতার ইশতেহার রচনা করেন। ওই ইশতেহারে প্রথমবারের মতো ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে স্বাধীন বাংলার জাতীয় সংগীত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
৩ মার্চ পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক বিশাল ছাত্রসমাবেশে সেই ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ। সংগঠনটির সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী পরে বলেন, তখন বিকল্প হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গানটিও বিবেচনায় ছিল। তবে গানটিতে ‘বাংলা’ বা ‘বাংলাদেশ’ শব্দ না থাকায় এবং রেকর্ড না থাকায় তা বাদ পড়ে।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া-তে ‘আমার সোনার বাংলা’ ব্যবহৃত হওয়ায় তখন এর রেকর্ড আমাদের হাতে ছিল। অন্যদিকে, বিকল্প গানটির রেকর্ড অনুপলব্ধ ছিল। ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে সেটিই ভূমিকা রেখেছিল।”
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গঠিত হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। শপথ গ্রহণের সময় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে আসা একদল গায়ক আনুষ্ঠানিকভাবে গেয়ে শোনান ‘আমার সোনার বাংলা’। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার তখনই গানটিকে সরকারিভাবে জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ‘আমার সোনার বাংলা’-র প্রথম দশ চরণই হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
বিআরইউ