বিসিএস আসক্তি থেকে বেরোতে অন্য চাকরিতে মর্যাদা বৃদ্ধি প্রয়োজন

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২২, ০৫:২৯ পিএম

প্রায় সকল শিক্ষার্থী একথা বর্তমানে অকপটে স্বীকার করেন যে, তাদের কাছে বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পেশার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের চাকরি। এই আকাঙ্ক্ষা শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরিতে মনোযোগ দিয়ে বিসিএস গাইড মুখস্থ করার দিকে, যার কারণে, বেশ কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগার বেশ পূর্ণ থাকে। শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে বসে থাকে, দেখতে ভালোই লাগে। 

কিন্তু হাতে তাদের বিসিএস গাইড। গণমাধ্যমের কল্যাণে শিক্ষার্থীদের সানন্দে বলে শোনা যায়, বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য লাইব্রেরিতে বসার জায়গা পেতে শিক্ষার্থীদের বেশ প্রতিযোগিতা করতে হয়। কাজেই এ কথা বলতে এখন আর আমাদের কোনো দ্বিধা নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এখন পড়তে, শিখতে ও জানতে আসে না। তারা শুধু চায় সনদ, যা তাদের বিসিএস পরীক্ষার আবেদনে কাজে লাগবে। আর বাকি সময় তারা বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তার আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। খুব সাধারণ কিছু হিসাব-নিকাশ বলে দেয় এ ট্রেন্ড বজায় থাকবে। তাই এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আগামী দিনগুলোতেও বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড হবে।

গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকে বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত ৬-৭ বছর তরুণরা বিসিএস পরীক্ষার পড়া ছাড়া আর কিছুই করছে না। এখন আবার এ দাবিও উঠে আসছে-বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার বয়সসীমা ৩৫ বছর করতে হবে। অর্থাৎ তরুণরা তখন দীর্ঘ এক যুগ বিসিএস নামের মরীচিকার পেছনে ছুটবে। দেশে শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান নিয়ে সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে করোনা শুরু হওয়ার তিন মাস আগে। 

সেই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩.৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭.৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮.১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। অর্থাৎ দেশের অর্ধেকেরও কম শিক্ষিত তরুণ পূর্ণকালীন কাজে আছে। বিসিএস নিয়ে এ প্রবণতা দেশের বেকার সমস্যার এক মহা উপসর্গ। অথচ বছর বিশেক আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিসিএস এতটা তাড়া করে ফিরত না। আশি এবং নব্বইয়ের দশকেও সরকারি চাকরিজীবী পরিবারগুলোতে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল বাস্তব। 

তবে এসকল বাধাবিপত্তি থাকা সত্বেও সোনার ডিম পাহা হাঁস নামক এই বিসিএস পরীক্ষায় ক্রমবর্ধমান আসক্তি বরাবরই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। কখনও মালদ্বীপ রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার সমান আবেদনকারীর সংখ্যা দাড়াঁয়। তাহলে চাকরি প্রার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কেন এই বিসিএস পরীক্ষা! 

এর উত্তরে জানা যায়, প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা মূলত বেতনের সাথে সাথে চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, ভ্রমণ, বাড়ি ভাড়া, কাপড় পরিষ্কার করার ভাতা, প্রেষণভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, যাতায়াত ভাতা, টিফিন ভাতা,ঝুঁকিভাতাসহ নানাবিধ সুবিধায় হাবুডুবু খায়।

অথচ, বেসরকারি চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এইসব ভাতা তেমন একটা নেই। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান দেয়ার চেষ্টা করলেও সিংহভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এই ধরনের সহায়ক ভাতা চাকরিরতরা পান না বলে নজির রয়েছে।

ফলে, নিরাপদ জীবিকা নির্বাহের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে শুধু বিসিএস নয় বরং একইসাথে সরকারি চাকরি ব্যবস্থাকে সবার উপর রাখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম।

যেকারণে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের প্রধান লক্ষ্য তৈরী হয়, যে করেই হোক বিসিএস ক্যাডার হতে হবে, যা হতে না পারলে তাদের জীবনটাই বৃথা। এমন দৃঢ় মনোবল নিয়ে শুরু করা কর্মজীবনের প্রবেশের পরীক্ষার তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের পাশাপাশি বাংলাদেশের লাখ লাখ স্নাতক/স্নাতকোত্তর পাসকৃতরা চোখ বন্ধ করে, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নাম কিংবা হনুলুলুর নাম মুখস্ত করে দিনের পর দিন বিসিএস'র পিছনে ছুঁটছে। বিষয়টি এমন যে, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার মানে জীবনের সব সফলতা হাতের মুঠোয় ধরা দেয়া। এমনকি এই চাকরিতে শুধু বেতন নয়, ক্ষমতার দাপট মেলে ধরার অন্যতম কৌশলও বাতলে দেয়া হয়।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের এক শিক্ষার্থী বর্তমানে বিবিএ এবং এমবিএ পরীক্ষা শেষ করে ঢাকায় মেস ভাড়া কনে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি তিনটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। তার একাডেমিক রেজাল্ট ৩ পয়েন্ট ৫ এর উপরে। 

তিনি বলেন, আমার বাবার একটি তাঁতের কারখানা রয়েছে। আমি চাইলে সেখানে ব্যবসা দেখাশোনা করতে পারি। এমনকি আমার ইচ্ছে রয়েছে তাতে। কিন্তু পরিবারের আগ্রহ আমি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং উত্তীর্ণ হই। সে আগ্রহের কথা বিবেচনা করে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৪১ তম বিসিএস-এ দুই হাজার ১৬৬ শূন্য পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ একটি আসনের বিপরীতে গড়ে ২২০ জন পরীক্ষা দিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ বিসিএস-এর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অন্য কোন দিকে ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন না। ফলে অকৃতকার্য হলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। বাস্তবতা হলো এ পরিসংখ্যান ক্রমবর্ধমান রূপে চলমান রয়েছে।

মূলত ২০১৫ সালে সরকারি চাকরির নতুন বেতন স্কেল ঘোষণার পরই ভালো বেতন, চাকরির নিশ্চয়তা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ও সম্মান-এমন আরও নানা দিক বিবেচনায় শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ারের মূল লক্ষ্য রাখছে বিসিএস-কে। তাদের মতে সরকারি চাকরির এসব সুবিধা বেসরকারি চাকরিতে নেই, আবার ব্যবসাতেও রয়েছে ঝুঁকি।

কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, কৃষি ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেও যারা শুধু বিসিএস এর পেছনে ছুটছেন তাদের পেছনে ব্যয়কৃত সরকারি খরচের পুরোটাই অপচয় হচ্ছে, এবং এক বক্তব্যে একে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

একসময় প্রশাসন ক্যাডার ছেড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন এমন উদাহরণ এক দশক আগে থাকলেও এখন এমন ভাবাটা পাগলের প্রলাপ মনে হবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা নেই, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার নেই, প্রকৌশলী বা ডাক্তারদের তেমন কোনও বড় অর্জনও এখন আমাদের চোখে পড়ছে না। যদিও কিছু স্বপ্নবাজ মেধাবী ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক বা শিক্ষক হিসেবে তার ক্যারিয়ারকে বেছে নেয় তাহলে তাদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় পদে পদে ক্ষমতাচর্চার বলি হয়ে।

ফলে গবেষণা বা সৃজনশীল সুন্দরের চর্চাও গতিহীন হয়ে আসক্তির কাছে পরাজিত হয়। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো চাইলেও সবাইকে চাকরি দিতে পারে না, অথচ একশ্রেণির মেধাবী শুধু ‘আসক্তি’র কারণে চাকরি পরিবর্তন করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিসিএস ক্যাডার তথাকথিত প্রথম সারির ক্যাডার নিয়ে যতটা তৎপর ততটা প্রচারণা কোনও বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক বা সৃজনশীল গবেষকদের নিয়ে করে না। ফলে সমাজের মেধার ও সম্মানজনক চাকরির একমাত্র মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে বিসিএস ক্যাডার বা কথিত প্রথম সারির ক্যাডার।

এমনকি বিয়ে থেকে প্রেম- এখন এমন অনেক সম্পর্কও এই মানদণ্ডতে মাপা হয়। যদিও সেখানে থাকে না সততা-নিষ্ঠা কিংবা সুখ শান্তির বিচার। এসব সামাজিক বাস্তবতা যেকোনও দেশের ক্ষতির কারণ হয়। তাই আমাদের সময় এসেছে অন্যান্য চাকরিতে যথাসম্ভব সম-সুবিধা নিশ্চিতসহ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে চাকরির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সাধারণ মানুষের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে আমরা আবারও আমাদের স্বপ্ন দেখতে চাই, ‘আসক্ত’ হতে চাই না। আর এজন্য প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার ও অন্য সব চাকরিজীবীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সংশ্লিষ্টদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখকঃ ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।