দেখা হলো তবে কথা হলো না!

ইসরাফিল ফরাজী প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২, ০৮:২৪ পিএম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমান দুইটি আলোচিত নাম। তারা দু‍‍`জনই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরীক্ষিত পক্ষ। দুই পরিবারের লড়াইয়ের শুরু প্রায় পাঁচ দশক আগের। খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবার আর আলী আহমেদ চুনকার পরিবার প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় দলীয় প্রার্থী হওয়াকে  ঘিরে দুই পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এই দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায় ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সেই নির্বাচনে জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের হোঁচট খান শামীম ওসমান। তখন নির্বাচন ঘিরে শামীম-আইভি একে অপরকে দোষারোপ ও বাক বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। এরপর থেকে আরো নানান ঘটনায় দুই পরিবারের দু’জনেই পরস্পরকে দোষাদোষী করতে দেখেছে দেশের মানুষ। এমনকি আলোচিত ত্বকী হত্যা ও সাত খুনের ঘটনায়ও দোষাদোষী চলে সমান তালে। একে অপরকে খুন, গুম, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। টেলিভিশনে সরাসরি সমপ্রচারিত টক-শোতেও শামীম ওসমান ও আইভীর মারমুখী বাক্য বিনিময় ও শক্তি প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ করতে দেখা গেছে। এমনকি সিটি করপোরেশনের ময়লা নিয়ে নোংরা রাজনীতি করা হয়েছে। আইভীকে কোণঠাসা করতে শামীম ওসমানের লোকজন অশ্লীল লেখা ও আইভীর বিকৃতি ছবি দিয়ে ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড বানিয়ে সারা শহর ছেয়ে দিয়েছেন। মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে বিষোদগার করেছেন।  

তাদের এ বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের কথা সারা দেশবাসীর অজানা নয়। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও এ বিষয়ে জ্ঞাত। গত কয়েকদিন আগেও তারা একে অপরকে উদ্দেশ্য করে তীর্যকমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাদেরকে সচরাচর এক মঞ্চে বসতে দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে বসে থাকলেও কোনো কথা হয় না।  

শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী একমঞ্চে বসেছিলেন। সম্মেলনের উত্তেজনাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো তাদের দুজনের মধ্যে কথা হবে কি না, সেই আলোচনা৷ শেষমেশ তাদের মাঝে আজও কোনো কথা হয়নি। সোনারগাঁ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি।

শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভী এক মঞ্চে একে অপরের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। পাশাপাশি একে অপরকে উদ্দেশ্য করে বিদ্বেষ ছড়ানো বক্তব্য দিয়েছেন।

অনুষ্ঠানে প্রথমে বক্তব্য দেন নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র আইভী। তিনি শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে বলেন, বিগত দিনের আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের ভূমিকা ছিল সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। এ জেলা থেকে জোহা-চুনকার মিছিল না গেলে ঢাকার সমাবেশ হতো না। কিন্তু এখন এক নেতার এক দেশ হয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ। আমি নারায়ণগঞ্জের নেতাদের বলছি, সবাইকে সমান সম্মান দেওয়া উচিত। এ দল (আওয়ামী লীগ) টিকে আছে তৃণমূলের জন্য। দুঃসময়ে যারা দলের হাল ধরে তাদের অসম্মান করার অধিকার নারায়ণগঞ্জের কোনো বড় নেতার নেই। আওয়ামী লীগের সুসময়ে যারা ছিল তাদেরকেই শুধু পদায়ন করলে চলবে না বরং যারা দুঃসময়ে ছিল তারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক, দলপ্রেমিক।

আইভী আরও বলেন, সোনারগাঁয়ে কী এমন হয়েছে যে বারবার এখানে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিতে হবে। নারায়ণগঞ্জে না হয় কারণ ছিল যে জোহা কাকার ছেলেকে (নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান) দিতে হবে। কিন্তু সোনারগাঁয়ে যার নাম ছিল না, নিশানা ছিল না তাকে কেন দিতে হবে। সোনারগাঁয়ের আওয়ামী লীগের নেতারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না নারায়ণগঞ্জের হস্তক্ষেপের কারণে। এখন অনেকেই অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের নামে স্লোগান দেয়। কিন্তু ক্ষমতা না থাকলে আর কেউ থাকে না। তারা ভেসে যাবে। তাই স্লোগান দিতে হবে আমাদের দলের ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে।

বিপরীতে শামীম ওসমান বক্তব্য দিতে গিয়ে আইভীসহ তার অনুসারীদের ইঙ্গিত করে বলেন, এখনো অনেকে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেন। অনেকে বলেন, অবস্থান পরিষ্কার করেন। কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জে জনসভা ডেকেছিলাম। সেটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। তারা বলেছিল, শামীম ওসমানের জনসভা। আমি শেখ হাসিনার কর্মী, শেখ হাসিনার কর্মী হয়েই মরতে চাই। ভাইয়ে ভাইয়ে অনেক বিরোধ থাকে। সবার কাছে অনুরোধ জানাতে চাই, আসুন ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আমরা এক থাকি। কারণ বাংলাদেশকে বাঁচাতে হবে। সেজন্য শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে হবে।

এর আগে জাতীয় শোক দিবস ও ২১ আগস্টের শহীদদের স্মরণে আয়োজিত এক আলোচনা সভা এবং দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। গত ৩০ আগস্টের ওই অনুষ্ঠানেও শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে কথা বলেন তিনি।

এ বিষয়ে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সামসুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, আমাদের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মেয়র আইভী ও শামীম ওসমান এক টেবিলেই বসেছিলেন। তবে তাদের মাঝে কোনো কথা হয়নি। সম্মেলনের কাজ শেষ হওয়ার পর দুইজন দুইজনের মতো চলে গেছেন।

এর আগে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ লাইনসে পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে এবং গত ২০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে এক টেবিলে বসেছিলেন। তবে সেদিনও তাদের মাঝে কোনো কথা হয়নি।

তার আগে গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের দুই নম্বর রেলগেট এলাকার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে শোকাবহ আগস্ট উপলক্ষে জনসভার আয়োজন করা হয়। আর সেই জনসভা প্রসঙ্গে আইভীর অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য ছিল, এটা শামীম ওসমানের ব্যক্তিগত সমাবেশ। তাই তারা কেউই সে সমাবেশে যোগ দেননি।


ইএফ