বায়ুশক্তি : বিদ্যুতে নতুন সম্ভাবনা

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: এপ্রিল ২৫, ২০২২, ১০:৫২ এএম

বর্তমান সরকারের সাফল্যের অন্যতম খাত বিদ্যুৎ। খাতটির অভাবনীয় সাফল্যে ইতোমধ্যে ৯৯.৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎতের আওতায় এসেছে। সরকারের চলমান উন্নয়নযজ্ঞ ও জনগণের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ অব্যাহত রাখতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী।

জলবিদ্যুৎ, সৌরশক্তির পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের সম্ভাবনাময় নতুন খাত হতে পারে বায়ুশক্তি। বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে টেকসই ও নবায়ণযোগ্য জ্বালানির চাহিদা পূরণ সহজ হবে— মত বিশেষজ্ঞদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ বায়ু বিদ্যুতের জন্য উপযোগী হলেও কাজে লাগানো হচ্ছে না। পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের কারণে বায়ু বিদ্যুৎ আশানুরূপভাবে এগোচ্ছে না। জলবিদ্যুৎ, সৌরশক্তির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য উৎসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বায়ু বিদ্যুৎ। বাংলাদেশে ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলসহ মোট এক হাজার ২০০ কিলোমিটার এলাকা বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে লাগানো যেতে পারে। 

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ফেনী নদীর মিরসরাইয়ের উপকূল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সারা বছর যে প্রাকৃতিক বায়ু প্রবাহ রয়েছে, যা দিয়েই কয়েকটি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে পুরো চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু কার্যকর উদ্যোগ ও বিনিয়োগ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এনআরইএলের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় প্রায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে যেখানে বাতাসের বেগ ৫.৭৫-৭.৭৫ মি./সে. যার মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। দেশের ৯টি স্থান বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুবই উপযোগী। এসব অঞ্চলে বিভিন্ন উচ্চতার টাওয়ার স্থাপন করে বায়ুপ্রবাহের তথ্য সংগ্রহ করেছে। 

এক বছর থেকে টানা ৪৩ মাস পর্যন্ত তারা তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষত খুলনার দাকোপ, চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং চাঁদপুরের নদী মোহনার এলাকাসমূহে ১০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের গড়বেগ ৬ মি./সে. এর বেশি যা বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। 

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি থেকে এক হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি থেকে অন্তত ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। 

পুরনো দুটির সাথে ইতোমধ্যে নতুন করে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। পরিকল্পনায় রয়েছে আরও দুটি। চট্টগ্রামের সীতাকণ্ডু, চাঁদপুর, ফেনী, পারকি, ইনানি, বরিশালের পায়রা, খুলনার মোংলা, সিলেটের হবিগঞ্জে, রংপুরের বদরগঞ্জ, ময়মনসিংহের গৌরিপুরে এবং রাজশাহীর লালপুরে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্ভাব্য যাচাই-বাছাই হচ্ছে। 

এছাড়া পুরো খাতটি প্রসারিত করতে তৈরি করা হচ্ছে একটি গাইড লাইন। গাইড লাইনটি তৈরি করার পর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প দ্রুত প্রসার লাভ করবে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব  (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) এ টি এম মোস্তফা কামাল জানান, বায়ু বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ উপযোগী। স্রেডা এ বিষয়ে কাজ করছে। সরকার নবায়ণযোগ্য জ্বালানির জন্য সম্ভাব্য সব খাতকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, বায়ু বিদ্যুতের জন্য সারা বছর পর্যাপ্ত বাতাস পাওয়া যাবে, এমন স্থান দরকার, কিন্তু সেটা পাওয়া কঠিন। আবার স্থান পাওয়া গেলেও ঘূর্ণিঝড়সহ নানা কারণে টারবাইন কতদিন টেকসই হবে, সেটাও দেখার বিষয় রয়েছে। কারণ টারবাইনের উপরে ১৫ টনের বেশি ভারী হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্র মতে, বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। 

এর মধ্যে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন, খুলনার মোংলায় ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সোনাগাজী ৩৫ ওয়ার্ড ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের কাজ চলছে। 

এর আগে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০০৫ সালে ফেনীর মহুরী নদীর লামছি মৌজায় ছয় একর জমির উপর স্থাপিত হয় বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হলেও পল্লীবিদ্যুতের একটি ফিডারে যোগ হয়ে তা বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা হলেও মেটাতে ভূমিকা রয়েছে। ২০০৭ সালে কারিগরি ক্রুটি, অব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় এর কার্যক্রম বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। 

পরবর্তীতে সংস্কার করে ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে তা পুনরায় চালু হয়। চালু হওয়ার পর ২০১৪ সালে মোট উৎপাদন হয়েছিল প্রায় দুই লাখ দুই হাজার ৪৩৯ ইউনিট। তখন গড় উৎপাদন ছিল দৈনিক ১৬ হাজার ৮৩০ ইউনিট। 

বর্তমানে পিডিবির প্রজেক্টের আওয়তায় প্যান এশিয়া পাওয়ার সার্ভিস লিমিটেডের মাধ্যমে চারটি টারবাইন দিয়ে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে ২২৫ কিলোওয়াট করে ৯০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটির সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ০.৯০ মেগাওয়াট। 

অন্য আরেকটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। ২০০৮ সালের পহেলা বৈশাখে এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বিতরণও করা হয়েছিল, যেখানে ছিল ৫০টি টারবাইন।  প্রতিটির ক্ষমতা ২০ কিলোওয়াট করে।  

অর্থাৎ এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এক মেগাওয়াট। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) সূত্র মতে, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়ন-প্রসার, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার ও উন্নয়ন, জ্বালানি সাশ্রয়ী যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ এবং নতুন সম্ভাবনাময় টেকসই জ্বালানির ক্রমাগত অনুসন্ধানে কাজ করছে স্র্রেডা। 

 স্রেডা সূত্র মতে, একটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রধান ও পূর্বশর্ত হচ্ছে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাই বা উইন্ড রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট। কোন স্থানে বিগত ১০ বছর ধরে বায়ুর গতিপ্রকৃতি কেমন বা পরবর্তী ১০ বছরের আবহাওয়ার সম্ভাব্য পরিবর্তন বিবেচনা করত সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। সাইট শর্টলিস্টিং এরপর মেট টাওয়ার বা রিমোট সেন্সিং যন্ত্রপাতি যেমন— সোডার, লাইডার ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট এলাকার ১২০ মিটার উচ্চতায় বায়ুর গতিবেগ, দিক, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ইত্যাদি তথ্যাদি অন্তত দুই বছর সংগ্রহ করা হয় এবং এ সব তথ্যাদি কোনো একটি সার্ভারে সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষিত করা হয়। এই তথ্য সংগ্রহের সময় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আইইসি ৬১৪০০১ অনুসরণ করতে হয়। 

তথ্যাদির মান নিশ্চিতকরণের পর শুরু হয় উইন্ড ফার্ম মডেলিং বা কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোন মডেলের উইন্ড টারবাইন ব্যবহার করে সর্বোচ্চ পরিমাণ বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব তা নির্ণয় করা। এটি বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রমের বড় একটি অংশ। উইন্ড ফার্ম মডেলিংয়ের পর নিশ্চিত একটি ধারণা পাওয়া যাবে কোনো এলাকায় বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বিনিয়োগকারীদের জন্য কতটা নিরাপদ।  

যেভাবে উৎপন্ন হয় বিদ্যুৎ : বায়ুশক্তি কাজে লাগাতে সুউচ্চ টারবাইন তৈরি করা হয়। প্রতিটি টারবাইনে তিনটি করে পাখা থাকে। এগুলোর উচ্চতা ১০০ থেকে ৪১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং পাখার আয়তন ৫০ থেকে ১১০ ফুট হয়ে থাকে। 

বায়ুর গতিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইনের জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বায়ু যখন টারবাইনের ব্লেডের মধ্যে দিয়ে যায় তখন বায়ুর গতিশক্তি ওই ব্লেডগুলোকে ঘুরায়। আর ওই ব্লেডগুলোর সাথে রোটর সংযুক্ত থাকে যা ব্লেডগুলোর ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়।

এই রোটর জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকে যার ঘূর্ণনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। সাধারণত যেসব জায়গায় বাতাসের গতিবেগ ২.৩ থেকে ২. ৫ মিটার/ সেকেন্ড হলেই বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে। কিন্তু পাঁচ থেকে ছয় মিটার/সেকেন্ড বাতাসের গতিবেগ হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করা সম্ভব। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট উপযোগী।