শ্রম আদালতের রায় বাস্তবায়ন হয় না

শরিফ রুবেল   প্রকাশিত: মে ১২, ২০২২, ০১:৩৮ এএম

নির্মাণশ্রমিক জুয়েল রানা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ৬০ কেজি ওজনের বালু কাঁধে নিয়ে মই বেয়ে ছাদে ওঠার সময় পড়ে গিয়েছিলেন। পড়ে যাওয়ার পর তার কোমরের নিচ থেকে শরীরের সম্পূর্ণ অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। 

চিকিৎসকরা জানান, বাকি জীবন তিনি হাঁটতে বা কোনো ধরনের কায়িক শ্রম করতে পারবেন না। দুর্ঘটনার সময় জুয়েল বাড়ির মালিক হাজী লিয়াকত আলীর অধীনে কাজ করছিলেন। জুয়েল ২০১৪ সালের জুনে লিয়াকতের বিরুদ্ধে দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন। 

দীর্ঘ চার বছর ধরে মামলা চলার পর জুয়েলের পক্ষে রায় দেন আদালত। তবে রায় পেয়েও ক্ষতিপূরণ পাননি। আদালত লিয়াকত আলীকে দুই মাসের মধ্যে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিলেও তিনি আদালতের আদেশ তোয়াক্কা করেননি। 

আদালতে বারান্দায় ঘুরে ঘুরে ২০২২ সালে এসেও জুয়েল একটি টাকাও বুঝে পাননি। পরে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়ে লিয়াকতের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে ব্লাস্ট। সে মামলাটিও আদালতে বিচারাধীন। শুধু জুয়েল রানা নয়, হাজার হাজার শ্রমিক মামলা করে আদালতের রায় পেয়েও পাওনা বুঝে পান না। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সময় সময় বেতন বোনাস না পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, গুরুতর আহত, অকারণে চাকরিচ্যুতসহ নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়ে প্রতিকার পেতে শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হন শ্রমিকরা। 

তবে আইনি সুরক্ষা পেতে আদালতে এসেও প্রতিকার মিলছে না। বরং জুটছে পদে পদে হয়রানি। মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় আদালতের নোটিসকে গুরুত্ব দেন না। নানা অজুহাতে বারবার সময় চেয়ে মামলা পেছাতে থাকেন মালিকরা। ফলে পাওয়া না পেয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় শ্রমিকদের। 

সাক্ষী না পাওয়া ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। এদিকে প্রতি জেলায় শ্রম আদালত না থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শ্রমিকদের। এক জেলার মামলা করতে যেতে হচ্ছে অন্য জেলায়। দুই বছর আগে দেশের নতুন সাতটি শ্রম আদালত স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। 

এছাড়া শ্রম আদালতগুলোতে চরম জনবল ও বিচারক সংকট রয়েছে। আইনজীবীরাও নিয়মিত আদালতে যান না। দীর্ঘদিন শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যানের পদও ছিল ফাঁকা। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। তাই নানা সমস্যায় জড়িয়ে একপ্রকার খুঁড়িয়ে চলছে শ্রম আদালত। মামলা পরিচালনাও সঠিকভাবে হচ্ছে না। 

এদিকে আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে মামলা। আদালতের সংখ্যা কম হওয়ায় মামলা পরিচালনা ও যাতায়াতের ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই। 

আদালত সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘসূত্রতার প্রধান কারণ হচ্ছে মিস মামলা, বাদী-বিবাদীদের শুনানির দিন আদালতে না আসা, শুনানির নোটিস না পাওয়ার অজুহাত ইত্যাদি। এদিকে একটি মামলার রায় দেয়ায় আইনানুযায়ী শ্রম আদালতের যে সময় নেয়ার কথা, তার চেয়েও ১০ গুণ বেশি সময় নিয়ে রায় দেন এই আদালত। 

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) এক গবেষণায় এই বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর শিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে দায়ের করা ৮০টি ক্ষতিপূরণ মামলা বিশ্লেষণ করেছে ব্লাস্ট। এই মামলাগুলোর রায় দিয়েছেন শ্রম আদালত। 

এদিকে  শ্রম অধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞরা বলছেন, শ্রমিকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলেও শ্রম আদালতের সংখ্যা কম হওয়া, শ্রম আইনের দুর্বলতা, অবকাঠামোর অভাব, দুই মন্ত্রণালয়ের দ্বৈত শাসনকে দায়ী করেছেন। অধিকারকর্মীরা বলছেন, আইনি কাঠামো এমনভাবে করে রাখা হয়েছে, যাতে শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার না পান। 

ঢাকার তিনটি শ্রম আদালতে শ্রমিকদের জন্য ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। তাদের ১০ জনই সরকারি দলের সমর্থক, আদালতে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না। আবার মালিকপক্ষের সদস্যরাও নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না, তাই মামলা ঝুলে যায়। আইনজীবী, ভুক্তভোগী ও আদালতের অন্যান্য সূত্রের তথ্যমতে, দেওয়ানি মামলাগুলো মূলত কর্মীদের বেতন বকেয়া সংক্রান্ত। 

অন্যদিকে ফৌজদারি মামলাগুলো মূলত কারখানা মালিকদের আইন না মানা-সংক্রান্ত। মামলাগুলো করেছে মূলত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাইফ) পরিদর্শক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো। এছাড়া রয়েছে শ্রম আদালতের আদেশ অবমাননা-সংক্রান্ত মামলাও। মামলাগুলোর নিষ্পত্তির হারও সন্তোষজনক নয়। সবচেয়ে বেশি মামলার জট প্রথম শ্রম আদালতে। এখানে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০টি মামলা হয়। আর গড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি নিষ্পত্তি হয় বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। 

দেশে বর্তমানে ১০টি শ্রম আদালত আছে, পাশাপাশি একটি শ্রমি আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। শ্রম আদালতের মধ্যে ঢাকায় আছে তিনটি। ঝুলে থাকা মোট মামলার ৮০ শতাংশই ঢাকার তিনটি আদালতে। শ্রম আদালতের মামলার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশের ১০টি শ্রম আদালতে মোট ২৪ হাজার ৩১টি মামলা (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ঝুলে আছে। 

সর্বোচ্চ জট ঢাকার তিনটি শ্রম আদালতে। প্রথমটিতে সাত হাজার ৭৫৭টি, দ্বিতীয়টিতে সাত হাজার ৬৮৫টি ও তৃতীয়টিতে পাঁচ হাজার ৩০৮টি। পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালত। প্রথমটিতে এক হাজার ৯০৬টি ও দ্বিতীয়টিতে ৭০০টি। এ ছাড়া শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা এক হাজার ৩৪৬টি।

এদিকে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আদালতটিতে শেষ পাঁচ বছরে (২০১৭ থেকে ২০২১ সাল) মামলা হয়েছে সাত হাজার ৮১৭টি। এর মধ্যে দেওয়ানি চার হাজার ৮১৭টি, ফৌজদারি দুই হাজার ২৯২টি ও মিস মামলা (বিবিধ মামলা) ৭০৮টি। একটি মামলার রায় যাওয়ার পর কোনো পক্ষের অনুরোধে তা পুনরায় চালু হওয়াকে মিস মামলা বলে। তবে শ্রম আদালতে মামলাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ পোশাকশিল্প খাতের বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। 

জানতে চাওয়া হলে ঢাকার শ্রম আদালত বারের সভাপতি সেলিম আহসান খান বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ায় আইনজীবীদেরও দায় আছে। আইনজীবীর একটা লক্ষ্য থাকে, যত দিন মামলা থাকবে, তত লাভ। মালিকপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের কাছে প্রতিবার তারিখ নেয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে ফি নেন। 

এছাড়া নানা অজুহাতে বিভিন্নভাবে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেন। মামলা ঝুলে গেলে একটা সময় বাদীও হাল ছেড়ে দেন, মামলা চালান না। ফলে সহজেই পার পেয়ে যায় মালিকপক্ষ। আদালতে কর্মচারীও খুব ক্ষমতাধর। কোনো কোনো বাদীর নথি দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যায় না। 

এগুলো কেউ না কেউ লুকিয়ে রাখছেন। শ্রম আইনের ২১৩ ও ৩৩ ধারার মামলায় সময় বেশি লাগছে। এসব ধারায় শুনানির সময় বিচারকের দুই পাশে দুজন সদস্য বসেন। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যদের মধ্যে আদালতে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের একজন করে সদস্য উপস্থিত থাকার কথা। 

তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ব্যস্ত। অনেক সময় শুনানিতে তারা উপস্থিত থাকেন না। যদিও রায়ে সদস্যদের মতামত দরকার। এ কারণে রায় দীর্ঘায়িত হয়।  বাংলাদেশ শ্রমিক সংহতি ফেডারেশন সভাপতি রুহুল আমীন বলেন, ‘আইনে শ্রম আদালতকে দেওয়ানি আদালত হিসেবে গণ্য করার কথা বলা আছে। এখানে দেওয়ানি আইন চলে। বাদীর সাক্ষ্য-জেরা, বিবাদীর সাক্ষী-জেরা হয়। 

তারপর যুক্তিতর্ক, রায়ের জন্য দিন ধার্য হয়। প্রায়ই মালিকপক্ষ নোটিশ পেয়েও উপস্থিত হয় না। এমনকি একতরফা রায়ের পরও নোটিস পেয়ে আসে না। তখন রায় লঙ্ঘনের জন্য ফৌজদারি আইনে মামলা হয়। তখন মালিকপক্ষ ‘মিস কেস’ করে, সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা ‘খরচা’ (জরিমানা) দিয়ে তা মূল মামলায় চলে যায়। এভাবে ১০ বছরেও মামলা নিষ্পত্তি হয় না। মামলা চলতেই থাকে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘শ্রম আইন কর্মীদের অধিকার রক্ষায় প্রণীত হলেও আদতে আদালতে গিয়ে শ্রমিকরা আরো হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মামলার রায় পেয়েও ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাচ্ছে না। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ অবজ্ঞা করছে।

আদালতে মামলাগুলো স্থগিত থাকা ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেরির কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পান না এবং হতাশ হয়ে পড়েন। বর্তমানে প্রচলিত আইনটিকে সংশোধন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণের নিয়মটি উঠিয়ে দিতে হবে এবং আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।