সব জেনেও চুপ বাংলাদেশ ব্যাংক

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২২, ০২:১২ পিএম

বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান ও প্রিন্সিপাল শাখা থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তিনটি অস্তিত্ববিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান।

হাউজিং ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানির নামে ‘টার্ম লোন’ হিসেবে ৯৪৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা তুলে নিয়ে এখন লাপাত্তা। ঋণের তথ্যে কোম্পানির পরিচালকদের পরিচয় গোপন থাকায় বাস্তবে এসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব আছে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবেও নেই ওই তিন কোম্পানির তালিকা। 

জানা গেছে, অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব ঋণ উত্তোলনের আলামত পাওয়া গেছে। ঋণ উত্তোলনের পর কোনো কিস্তি পরিশোধ করেনি ওইসব অস্তিত্ববিহীন কোম্পানি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পরিদর্শক দল আইএফআইসি ব্যাংক পরিদর্শনকালে এসব তথ্য উঠে আসে। পরিদর্শনে জালিয়াতির চিত্র উঠে এলেও অদৃশ্য কারণে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিদর্শন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল প্রতিবেদন তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করে। এরপরই ফাইলটি অন্ধকারে চলে যায়। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘যেহেতু একটি ব্যাংকের বড় ঘটনা, তাই অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না।’ এরপর ১৫ দিন সময় নিয়ে তিন দফা তার কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে এ ব্যাপারে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বারবারই পরে জানাবেন বলে জানান। 

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মুখপাত্রের কার্যালয়ে গেলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি এখনো তথ্য পাইনি।

আইএফআইসি ব্যাংকের একটি সূত্রের দাবি, প্রভাবশালী একজন পরিচালক ঋণ বিতরণের সব ধরনের নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে এ অর্থ হাতিয়ে নেন। সূত্রের তথ্যের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের মিল রয়েছে।

এতে দেখা যায়, কোম্পানির পরিচালকের নামের জায়গা খালি রেখে ঋণ আবেদন করা হয়। অন্যদিকে কোনো জামানত ছাড়াই (ঋণ বিতরণের পর অতিরিক্ত ছয় মাস সময় দিয়ে) ঋণ ছাড় করে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। 

এছাড়া ঋণ হিসাব সৃষ্টিকালে পর্ষদ সভায় অনুমোদিত সময়ও বর্ধিত করা হয়েছে। অন্যদিকে হাউজিং লোনের ক্ষেত্রে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্থাপনা নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে ধাপে ধাপে ঋণ ছাড় করার নিয়ম থাকলেও কোনো পরিদর্শন ছাড়াই একযোগে মোটা অঙ্কের অর্থ ছাড় করা হয়েছে, যা জালজালিয়াতির স্পষ্ট প্রমাণ। এছাড়া রাজ হাউজিং নামের কোম্পানিটি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে কবরস্থান ও নদীভাঙনে নিশ্চিহ্ন জমি জামানত হিসেবে প্রদান করেছে বলে জানা গেছে। 

সূত্রের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় আইএফআইসি ব্যাংকের ৭১১তম সভার কার্যবিবরণীতে দুটি অস্বাভাবিক ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে সৃষ্টি রিয়েল এস্টেট লি. এর অনুকূলে চার বছরমেয়াদি ১৯৯ কোটি টাকার টার্ম লোন অনুমোদন করা হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানির পরিচালকদের নামের স্থান খালি রাখা হয়েছে এবং ঋণের বিপরীতে সম্পত্তি জামানত রাখার জন্য ঋণ বিতরণের পর অতিরিক্ত ছয় মাস সময় দেয়া হয়েছে। 

অর্থাৎ, জামানত ছাড়াই ঋণ ছাড় করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া বড় অঙ্কের ঋণের গ্রাহকের পরিচয় গোপন থাকা সত্ত্বেও পরিচালনা পর্ষদ কীভাবে ঋণটির অনুমোদন দিল— তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, একজন প্রভাবশালী পরিচালক অন্য পরিচালকদের ম্যানেজ করে ঋণ অনুমোদন নিয়েছেন। একইসঙ্গে পরিচয় আড়াল করতে কাগুজে কোম্পানিটির পরিচালকের নাম গোপন রাখা হয়েছে। 

একইভাবে রাজ হাউজিং লি. এর অনুকূলে চার বছরমেয়াদি ৮৪ কোটি টাকার টার্ম লোন অনুমোদন করা হয়। বৃহদাঙ্কের ঋণ অনুমোদন করা হলেও এখানেও কোম্পানির পরিচালকদের নামের স্থান খালি রাখা হয়েছে এবং কোনো জামানত বা সহজামানতের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

তাছাড়া, পর্ষদ সভায় ঋণসমূহের মেয়াদ চার বছর অনুমোদন করা হলেও শাখায় ঋণ হিসাব সৃষ্টিকালে সব ক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদ প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ, এ ঋণটিও কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে অনুমোদন ও ছাড় করা হয়েছে। 

আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান ও প্রিন্সিপাল শাখার ২০১৯ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের সিএল বিবরণীর তথ্যমতে, রাজ হাউজিং লিমিটেড, সৃষ্টি রিয়েল এস্টেট লিমিটেড এবং কুইক রিয়েল এস্টেট— এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে পাঁচ বছরমেয়াদি মোট ছয়টি টার্ম লোন হিসাব সৃষ্টি করে ৯৪৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ প্রস্তাবনায় ২৫০টি ফুল ফার্নিশড ডুপ্লেক্স বিল্ডিং নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্থাপনা নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে ধাপে ধাপে ঋণ ছাড় করার কথা। কিন্তু কোনো মনিটরিং ছাড়াই এককালীন ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করা হয়েছে। অর্থ উত্তোলনের পর কোম্পানিগুলো প্রস্তাবিত খাতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে বলে প্রমাণিত হয়নি। কারণ, লোনের কোনো কিস্তি পরিশোধ করেনি কোম্পানিগুলো।

ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, বাস্তবে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি। মূলত একজন পরিচালক তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন। 

জামানত হিসেবে যে জমির কাগজপত্র দেয়া হয়েছে, তা অনেক আগেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া কবরস্থানের জমিতে বিল্ডিং নির্মাণের কথা বলে ঋণ নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে জালিয়াতির এমন চিত্র। এতে দেখা যায়, ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময় অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় বা শাখা থেকে কোনো মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়নি। অর্থাৎ, পরিচালনা পর্ষদ জেনে-বুঝে অর্থ লোপাটের সুযোগ করে দিয়েছে। 

ঋণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজ হাউজিং লিমিটেডের নামে আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০১৭ সালের ২০ জুন ২০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। যার হিসাব নম্বর- ১১৭০৬২০০০০০০১। এর দুই মাস পর (২২ আগস্ট, ২০১৭) একই শাখা থেকে ৬০ কোটি টাকা ছাড় করা হয় রাজ হাউজিংয়ের অন্য একটি হিসাবে (নং- ১১৭০৮২৭০০০০০০১)। 

গুলশান শাখা থেকে রাজ হাউজিংয়ের হিসাব নং- ১১৭১১০১০০০০০১-এ আরও ৮৪ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে একই বছরের ১৯ অক্টোবর। ব্যাংকের একই শাখা থেকে সৃষ্টি রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির দুটি হিসাবে (যথাক্রমে ১১৭১০২৩০০০০০১ ও ১১৯০৩২৭০০০০০১) ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ১৬০ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালের ২০ মার্চ আরও ৯৫ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। 

এছাড়া কুইক রিয়েল এস্টেট নামের অপর একটি কোম্পানিকে ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখা থেকে ৩৪৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়। যার হিসাব নম্বর ১১৭১২২৪০০০০০১। উল্লিখিত হিসাবসমূহে ছাড়কৃত মোট টাকার পরিমাণ ৯৪৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কোনো কিস্তি আদায় না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনকালে দায়সহ মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার চার কোটি ৫৬ লাখ টাকা।   

ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মাদ শাহ আলম সরোয়ারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টিকে গ্রাহকের গোপনীয়তা উল্লেখ করে আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমার ক্লায়েন্টের কনফিডেন্সিয়ালিটি আপনার সাথে ডিসকাস করতে পারি না।’