কোটার গেঁড়াকলে শিক্ষার্থীরা

মুছা মল্লিক প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০২২, ০১:০১ এএম

অসচ্ছল দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বিনা বেতনে পড়ানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে। কিন্তু বাস্তবে তার চিত্র ভিন্ন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ এক সেমিস্টার বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেলেও খাতা-কলমে তাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক কোটায় গণনা করা হচ্ছে।

কোথাও আবার ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের আত্মীয়-স্বজনের সন্তানকে দরিদ্র দেখিয়ে বিনা বেতনে পড়ানো হচ্ছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আবার ইচ্ছামাফিক শর্ত জুড়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের এ সুযোগ নিয়েও নয়-ছয় করছে।

ইউসিজির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আইন থাকার পরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীকেও এ সুযোগ দেয়নি। এতে একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, অপরদিকে কোটার গেঁড়াকলে সুবিধাবঞ্চিত ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের অনুসন্ধান বলছে, ২০১০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গরিব বা মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তি কোটা ও গবেষণার কাজে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি। এদিকে আইন অমান্য করায় দফায় দফায় হুঁশিয়ারি জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দিয়েছে খোদ ইউজিসিও।

অপরদিকে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত কতজন দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান টিউশন ফি ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে— তার প্রতিবেদন চেয়েছেন হাইকোর্ট। তবে কোর্টের বেঁধে দেয়া সময় অতিবাহিত হলেও এখনো কোনো তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি মঞ্জুরি কমিশন।

মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হওয়া এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই তৈরি করছে ইচ্ছামাফিক আইন ও তার বাস্তবায়ন। অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলেও বছর বছর ছাত্র ভর্তি করে সার্টিফিকেট বিতরণ করাই যেন তাদের প্রধান পেশা হয়ে উঠেছে।

শিক্ষার নামে এসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিলেও শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের জন্য কতটুকু যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠতে পারছেন— সেদিকে খেয়াল রাখার কোনো দায়িত্বই যেন তাদের নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ধারা ৯(৪) অনুযায়ী, ৩ শতাংশ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী এবং ৩ শতাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে কোনো ফি ছাড়াই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

একই আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী সরকারের কর্তব্য হচ্ছে আইন ভঙ্গ হলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল এবং সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করার। অপরদিকে ধারা ৪৯-এ বলা হয়েছে, এগুলো ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং উভয় দণ্ডের বিধানও রয়েছে।

তবে বিগত বছরগুলোতে এমন অনিয়মের কারণে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির পাওয়া যায়নি। তবে আইন থাকার পরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন স্বেচ্ছাচারিতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতার দিকেই ইঙ্গিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন,  বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শর্ত জুড়ে দিয়ে তথ্য লুকিয়ে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। অপরদিকে উদ্যোক্তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান মনে করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও তারা এটাকে আয়ের উৎস হিসেবেই দেখেন।

বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তাদের বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অর্জনের এমন মানসিকতা একদিকে যেমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করছে, অপরদিকে শিক্ষার্থীদের জন্যও নামে-বেনামে অজস্র মনগড়া এসব আইন রীতিমত জুলুমে পরিণত হচ্ছে।

ইউজিসি বলছে, ২০২০ সালের ৯ আগস্ট এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা ৯৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকৃত পূর্ণকালীন শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম ৬ শতাংশের মধ্যে ৩ শতাংশ আসন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং ৩ শতাংশ আসন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেধাবী অথচ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।

এসব শিক্ষার্থীকে টিউশন ও অন্যান্য ফি ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ দিতে হবে। প্রতিবছর অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থীর তালিকা কমিশনে দাখিল করতেও নির্দেশ দেয়া হয় ওই চিঠিতে।

চিঠিতে বলা হয়, কমিশন লক্ষ করছে, বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ দিচ্ছে না এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী সুযোগ দিচ্ছে— যা আইনের চরম ব্যত্যয়ের শামিল।

এ প্রসঙ্গে মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম আমার সংবাদকে বলেন, আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তথ্য আনতে চেষ্টা করছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সময় বেশি লাগছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তারা নির্ধারিত কোটা (অসচ্ছল মেধাবী ও মুক্তিযোদ্ধা) পূরণের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষার্থীই পাচ্ছে না।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, তারা বিজ্ঞাপন দিয়েও এসব কোটায় শিক্ষার্থী পায় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেপরোয়া নীতিকে একটি নির্ধারিত নিয়মে আনতে আমরা প্রতিনিয়ত নানা উদ্যোগ নিয়েছি।

সর্বশেষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। নতুন এ আইন পাস হলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি নির্ধারিত নিয়মে নিয়ে আসা যাবে।

বিদ্যমান যে আইন আছে, সে অনুযায়ী আমরা অনবরত সুপারিশ করছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো আইন অমান্য করলে নানা জটিলতায় ইউজিসি সরাসরি পদক্ষেপ নিতে পারে না।

তিনি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এমনকি প্রধানমন্ত্রী বরাবরও এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। সবাই এটা জানে। কিন্তু সব সমস্যা জানার পরও ইউজিসির করার কিছুই নেই। আশা করছি নতুন আইনে কোনো ফাঁকফোকর থাকবে না; সুতরাং সহজাতভাবেই অন্যায় করে কেউ পার পাবে না।

তথ্য চাওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সময়ক্ষেপণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ইউজিসি যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কাজ করছে, সেহেতু সব তথ্য তাদের কাছে থাকার কথা। তারা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে তথ্য চেয়েও নির্ধারিত সময়ে না পায়,  সেক্ষেত্রে ইউজিসির ব্যর্থতা রয়েছে।

ইউজিসি যেহেতু শক্তভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না; তাই এ দায় তাদের নিতে হবে। যারা আইন প্রণয়ন করে, তারাই যদি আইনের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে তো সমস্যা থাকবেই।

তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, সে আইন সংশ্লিষ্টদের সাথে পরামর্শ করে করা হয়নি। যাদের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়, তাদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে আইন করলে তা প্রয়োগ করতে সহজ হয়।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থী তাদের ন্যায্য সুবিধা পাচ্ছে না। সুতরাং প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই সুযোগ অবারিত করতে হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনায় সব তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে।

ইউজিসির হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। কোটা আইনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ওয়েভার পলিসিকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখানো হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এ সুযোগ পেলেও দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে এসব আইন মানছে— এর প্রমাণ আমরা পাইনি; একইসাথে ইউজিসিও পায়নি।

এ বিষয়ে কথা হলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আমার সংবাদকে জানান, আমরা এখনো যাচিত তথ্য পাইনি। তথ্য পাবার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক একটি চিত্র উঠে আসবে। যেহেতু এখনো বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে, সেহেতু এ মুহূর্তে বিস্তারিত বলা সম্ভব হচ্ছে না।