বিশ্বফুটবলের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃত লিওনেল মেসি আজ ফুটবলজগতের এক অনন্য নাম।
বার্সেলোনার সেই ক্ষুদে জাদুকর, যিনি তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে একের পর এক ডিফেন্ডারকে ছেঁচে গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে দিয়েছেন বারবার, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামি ক্লাবে খেলছেন।
তবে প্রশ্ন উঠেছে—মেসি কি এখনো তার জাদু দেখাতে পারছেন? তার আগের ক্লাবগুলোর মতো ইন্টার মায়ামিতে কি তিনি একইভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—২০২৬ সালের বিশ্বকাপে আমরা তাকে আবার আর্জেন্টিনার জার্সিতে দেখতে পারবো কি?
ইন্টার মায়ামিতে মেসি: জাদুর ছোঁয়া এখনো অব্যাহত?
২০২৩ সালে ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেন মেসি, ইউরোপ ছেড়ে মার্কিন মাটিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। ক্লাবে যোগদানের পরপরই তার প্রভাব স্পষ্ট হয়—দলটা যেন হঠাৎই প্রাণ ফিরে পায়। তার নেতৃত্বে ইন্টার মায়ামি ২০২৩ সালের লিগস কাপ জিতে নেয়, যা ক্লাবটির ইতিহাসে প্রথম বড় শিরোপা। মেসি নিজেই সেই টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন, এবং সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেন। তবে মেজর লিগ সকারের নিয়মিত মৌসুমে দলটি মিক্সড পারফরম্যান্স দিয়েছে, যা কিছুটা হতাশাজনক।
তার খেলায় এখনো কারিগরি মুন্সিয়ানা, অবিশ্বাস্য পাসিং, এবং নিখুঁত ফ্রি-কিক রয়েছে, তবে বয়স যে তাকে ছুঁয়ে গেছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। ইনজুরি ও শারীরিক ক্লান্তি মাঝে মাঝে পারফরম্যান্সে ছাপ ফেলেছে।
তবুও মার্কিন ফুটবলের বাজারে তার প্রভাব তুলনাহীন—গ্যালারি ভরছে, জার্সি বিক্রি বেড়েছে, এবং বিশ্বজুড়ে মায়ামির ম্যাচে নজর দিচ্ছে ফুটবলপ্রেমীরা।
বার্সা থেকে পিএসজি: অতীতের গৌরবময় অধ্যায়
মেসির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় নিঃসন্দেহে বার্সেলোনা। ২০০০ সালে এক কিশোর হিসেবে যোগ দেওয়া ক্লাবটিতে ২১ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। ৭৭৮ ম্যাচে করেছেন ৬৭২ গোল, জিতেছেন ১০টি লা লিগা, ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৭টি কোপা দেল রে—এবং অসংখ্য ব্যক্তিগত পুরস্কার, যার মধ্যে সাতটি ব্যালন ডি’অর অন্যতম।
২০২১ সালে আর্থিক জটিলতার কারণে বার্সেলোনা ছাড়তে হয়, এবং তিনি যোগ দেন ফ্রেঞ্চ জায়ান্ট প্যারিস সেন্ট জার্মেইনে (পিএসজি)। সেখানে দুই মৌসুম কাটালেও ঠিক নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন—কিছুটা নিষ্প্রভ, ক্লাব ও সমর্থকদের সঙ্গে রসায়নও খুব বেশি জমেনি। তবে ২০২২ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জেতার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন পূরণ করেন।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ: বিশ্বকাপে মেসি থাকবেন?
২০২৬ সালের বিশ্বকাপ হবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে। তখন মেসির বয়স হবে ৩৮ ছুঁইছুঁই। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, এটি তার জন্য কঠিন হবে, তবে একেবারে অসম্ভব নয়। এখনো পর্যন্ত আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনির পরিকল্পনায় তিনি রয়েছেন, এবং কনমেবল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও নিয়মিত খেলছেন। তার ফর্ম, ইনজুরি পরিস্থিতি এবং মানসিক প্রস্তুতি—এই তিনটি বিষয়ের ওপরই নির্ভর করবে তিনি শেষবারের মতো বিশ্বমঞ্চে নামবেন কিনা।
মেসি নিজে বলেছেন—“আমি প্রতিদিন খেলে যাচ্ছি, দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছি। এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলতে চাই না, তবে চেষ্টা থাকবে যদি শরীর-মন সুস্থ থাকে।”
মায়াবী কি বিদায়ের গল্প লিখছে ধীরে ধীরে?
মেসির ক্যারিয়ার এখন এক সন্ধিক্ষণে। তার অতীত গৌরব যতটা উজ্জ্বল, বর্তমান ততটাই নরম ও আবেগময়। ইন্টার মায়ামিতে তিনি একটি নতুন ফুটবল সংস্কৃতির অংশ হয়েছেন, যেখানে তিনি খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি—একজন দূত, একজন অনুপ্রেরণা। কিন্তু ফুটবল ভক্তদের হৃদয়ে একটাই প্রশ্ন—এই কিংবদন্তিকে আমরা আর একবার বিশ্বকাপের মঞ্চে দেখতে পারবো তো?
ফুটবল তো শেষ কথা নয়, এটা অনুভবের খেলা। আর মেসি সেই অনুভবের নাম, যার বিদায়টা যত দেরিতে হয়, ততই মঙ্গল।
ইএইচ