জটিল ধাঁধায় ডলার মার্কেট

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২২, ১২:৫৬ এএম

করোনার প্রকোপ কাটতেই বাড়ে আমদানির চাপ। ফলে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতিতে তৈরি হয় ডলার সংকট। বাজার স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ডলার সহায়তা দিতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তবুও কমেনি অস্থিরতা। বলা হচ্ছিল— হজের কারণে চাহিদা বেশি তাই সংকট কাটছে না। কিন্তু সে চাপও কেটে গেছে, আমদানিতে লাগাম টানা, আছে বিদেশ ভ্রমণে বিধিনিষেধ, আন্তর্জাতিক বাজারে কমে গেছে কিছু পণ্যের দাম।

তবুও ডলার বাজারে অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ চাহিদার কারণে ডলার বাজারে টালমাটাল অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ব্যাংকগুলোকে ডলার দিচ্ছে তার চেয়ে ১৫-১৮ টাকা বেশি দামে খোলাবাজারে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। ব্যাংকও ৮-১০ টাকা লাভে ডলার বিক্রি করছে। সব মিলিয়ে ডলারের ভুতুড়ে চাহিদা এখন জটিল ধাঁধায় রূপ নিয়েছে।

সাধারণত বিদেশে ভ্রমণ, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা-সংক্রান্ত খরচের জন্য মানুষ খোলাবাজার কিংবা ব্যাংক থেকে ডলার কিনে। কিন্তু খোলাবাজারে গেল কয়েক দিনে বেশ বড় অঙ্কের ডলার কেনার চাহিদা আসছে, যা মানুষের ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের স্বাভাবিক চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি।

তাই পাচারের বিষয়ে সামপ্রতিক কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বিনিয়োগের উদ্দেশে কিছু মানুষ ডলার কিনছেন বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

তথ্যমতে, দেশে অনুমোদিত মানিচেঞ্জার ৬০২টি, এর মধ্যে ২৩৫টির বৈধতা আছে। বাকিগুলোর লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল রয়েছে। জানা গেছে, লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল হওয়া কিছু মানিচেঞ্জার ডলারের অবৈধ ব্যবসায় নেমেছে। মানিচেঞ্জারের বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ের অবৈধ লেনদেনে কোনো কাগজপত্র লাগে না।

এ রকম কয়েকজন বিক্রয়কর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সামপ্রতিক সময়ে তারা বড় অঙ্কের ডলার কেনার অর্ডার পাচ্ছেন। ক্রেতাদের সবাই বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা, সভা-সেমিনারে অংশ নিতে যাওয়ার জন্য এই ডলার কিনছেন, তেমন নয়।

তাদের ধারণা, ব্যাংকিং খাতে কড়াকড়ির কারণে এক শ্রেণির ব্যক্তি ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ ডলার কিনছেন। আরেক শ্রেণি শেয়ারবাজারের মতো ডলারে বিনিয়োগ করছে। সঞ্চয়পত্রে কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে কেউ কেউ দুর্নীতির টাকায় ডলার কিনে রাখছেন। ডলার পাচারও হতে পারে বলে তাদের ধারণা।

মানিচেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এ কে এম ইসমাইল হক বলেন, ‘গত কয়েক দিন ডলারের ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। দর আরও বাড়বে ভেবে অনেকে হয়তো ডলার মজুত রাখছেন। পাচার বা অন্য কিছু ঘটছে কি-না, সে বিষয়ে ধারণা নেই।’

গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘নির্বাচনের আগে অর্থপাচার বাড়ে বলে ধারণা করা হয়। ডলার পাচার হচ্ছে কি-না, তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো খতিয়ে দেখতে পারে। আমদানি ও রপ্তানির মূল্য কমবেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের প্রবণতা বিশ্বজুড়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এখন খোলাবাজারে ডলারের দরের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পাচারের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সাথে সম্পর্কিত কর্মকর্তারা বলছেন, ‘আমদানি বা রপ্তানিতে যথাযথ মূল্য না দেখিয়ে অনেকে অর্থ পাচার করেন। ঘোষিত অর্থের বাইরে যে অঙ্ক থাকে, তা সাধারণত তৃতীয় দেশের সহায়তায় টিটির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। পরিস্থিতি ঠিক রাখতে হলে কঠোরভাবে আমদানি তদারকি করতে হবে। তা না করতে পারলে ডলার পাচার ঠেকানো যাবে না।’ সরকারবিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে ডলার সংকটের কারণ হিসেবে পাচার ও সরকারে অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘রাজনীতির মতো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সরকার অকার্যকর করে ফেলেছে। বর্তমানে আর্থিক খাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই, তাই এমন হচ্ছে।’ এ ছাড়া বিভিন্নভাবে ডলার পাচার হচ্ছে বলে মনে করেন এ রাজনীতিবিদ।

তিনি বলেন, ‘সরকার দলের অনেকে ভবিষ্যতে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছে। তারাও ডলার পাচারে জড়িত থাকতে পারে।’

অন্যদিকে, গত বুধবার ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘কেউ যদি কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে দাম বাড়িয়ে আমদানির ব্যবস্থা করছে। বাধা দিলে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। সরকার এ ধরনের তৎপরতা বন্ধ করার চেষ্টা করছে।’ ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি চালানোর আহ্বান জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সাথে সাক্ষাতকালে সংগঠনটির সভাপতি জসিম উদ্দিন এ আহ্বান জানান।

গভর্নরের সাথে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কিছু বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ডলার সংকটের সুযোগ নিয়ে দ্রুততম সময়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে। এক ডলারে ১০ টাকা লাভ করার জন্য ব্যাংককে লাইসেন্স দেয়া হয়নি  বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অস্থির ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণ ও কারসাজি বন্ধে অভিযান চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন অনিয়ম পাওয়ায় এখন পর্যন্ত ১১টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়েছে। গত বুধ ও বৃৃহস্পতিবার অভিযান পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি পরিদর্শন দল।

এরপরও ডলার নিয়ে কারসাজি হলে সংশ্লিষ্ট মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

অভিযান সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘খোলাবাজারে এক ডলারের বিপরীতে দিতে হচ্ছে ১১২ থেকে ১১৪ টাকা, এমন খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডলার নিয়ে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’

অন্যদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকে অবৈধভাবে ডলার মজুত করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির এই সময়ে কেউ অবৈধভাবে ডলার মজুত করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।এ ছাড়া জাল ডলার তৈরির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন মনে করেন, ‘একটি গোষ্ঠীর মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার কারণে ডলারের বাজার অস্থির হয়েছে।’ তবে কোন গোষ্ঠী বাজার অস্থির করেছে তাদের নাম বলেননি তিনি। বৃহস্পতিবার ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে পর্যন্ত আমদানিতে খরচ হয়েছে সাত হাজার ৫৪০ কোটি ডলার। একই সময় পর্যন্ত রপ্তানি আয় হয়েছে চার হাজার ৪৫৮ কোটি ডলারের মতো। এতে করে প্রথম ১১ মাসে রেকর্ড তিন হাজার ৮২ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

একই সময়ে রেমিট্যান্স প্রায় ১৬ শতাংশ কমে এক হাজার ৯১৯ কোটি ডলারে নেমেছে। সব মিলিয়ে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। বিপুল এই ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো ছুটছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করে। এ অর্থবছরের এক মাস না পেরোতেই আরও ১১০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। যে কারণে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ এখন ৩৯ দশমিক ৪৮ বিলিয়নে অবস্থান করছে।

তাই আমদানি খরচ কমাতে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, স্বর্ণসহ ২৭ ধরনের পণ্যের এলসিতে শতভাগ মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ কিছু পণ্যের বাইরে অন্য ক্ষেত্রে মার্জিনের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে আমদানিতে কোনো ঋণ দেয়া যাবে না।’

এছাড়া ডলারের খরচ কমাতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প খরচ কাটছাঁট ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে লাগাম টানা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ সাশ্রয়ে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন নির্দেশনা। বাজারে সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইডিএফ থেকে নেয়া ঋণ কেবল রপ্তানি আয় বা জমা থাকা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময়ে দেয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আবার বিদেশে আটকে থাকা ১৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি বিল ও দায় পরিশোধ হলেও দেশে না আসা ৮৮০ কোটি ডলারের পণ্য দ্রুত আনার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া এখন থেকে প্রবাসীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে দূতাবাসের সত্যায়ন লাগবে না। এতদিন প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস থেকে কাগজপত্র সত্যায়নের শর্ত ছিল ব্যাংকগুলোর। এ শর্তের কারণে অনেক সময় অ্যাকাউন্ট খোলার আগ্রহ হারান প্রবাসীরা। এমন বাস্তবতায় প্রবাসীদের অ্যাকাউন্ট খুলতে দূতাবাস থেকে কাগজপত্র সত্যায়নের আবশ্যকতা দেয়া যাবে না।

গত বুধবার বিএফআইইউ থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা ব্যাংকগুলোতে পাঠানো  হয়েছে। এসবের ইতিবাচক প্রভাব কিছু দিনের মধ্যে পড়বে বলে ধারণা করছেন ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, আগের মাসের চেয়ে গত জুন মাসে এলসি নিষ্পত্তি প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়ে ৮৫৫ কোটি ডলারে ওঠে। জুন মাসে নিষ্পত্তি হওয়া এলসির বড় অংশ আগে খোলা। আর এলসি খোলা কমে যাওয়ার মানে নিকট ভবিষ্যতে আমদানি ব্যয় কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লি

ষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জুলাইতে এলসি আরও কমেছে। মূল্য বিবেচনায় ২৭ তারিখ পর্যন্ত কমার হার ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময় পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ১৯০ কোটি ডলার। মাস শেষে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আগের মাস জুনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৪ কোটি ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।