ড্রেসকোডে আক্রমণাত্মক শিক্ষক!

বেলাল হোসেন প্রকাশিত: আগস্ট ১১, ২০২২, ১২:৫১ এএম

শিক্ষার্থীরা স্কুলে একটু-আধটু ভুল করলেই এখন শাস্তির ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করছেন অভিভাবকরা। সম্প্রতি বেশ কিছু স্কুলে ড্রেস ও জুতা পরিধান না করায় শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। কিছু শিক্ষকের আক্রমণাত্মক আচরণে শিক্ষার্থীরা ভয়ে স্কুলে আসতে চাচ্ছে না।

পরবর্তীতে অভিভাবকরা বুঝিয়ে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, থানা পর্যায়ে স্বল্প আয়ের পরিবারের সন্তানদের অনেক সময় স্কুল ড্রেস একটা থাকার কারণে তাদের সপ্তাহে হঠাৎ দু’-একদিন ড্রেস পরে আসতে সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আক্রমণাত্মক শাসন পরিহারের কথাও বলেছেন অনেক অভিভাবক।

চলতি বছরের প্রথম ঘটনাটি ঘটে গত মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরশহরের নাছরীন নবী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। জানা গেছে, নির্ধারিত স্কুল ড্রেস ও জুতা পরে না আসায় ষষ্ঠ ও দশম শ্রেণির প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। 

অভিভাবকরা জানান, বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালে কিছু শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফিরিয়ে নেয়া হয়।

তবে শিক্ষার্থীদের বের করার বিষয়টি অস্বীকার করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবব্রত বণিক। বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, স্কুলের ক্লাসরুমে প্রবেশ করতে হলে শিক্ষার্থীদের ড্রেসকোড মানতে হয়। এ জন্য ড্রেস ও জুতা চেক করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এসময় সবার নির্ধারিত ড্রেস থাকলেও অনেকের জুতা ছিল ভিন্ন। কেউ কেউ স্যান্ডেল পরে এসেছে। এ সময় প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিখা রানী বণিক শিক্ষার্থীদের ক্লাস থেকে বের করে দেন।

গত ৬ এপ্রিল নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নির্ধারিত স্কুল ড্রেস না পরার কারণে শিক্ষার্থীদের মেরেছিলেন শিক্ষিকা আমোদিনী পাল। পরবর্তীতে হিজাব ইস্যুর গুজবে রূপ নেয় ঘটনাটি এবং তদন্ত করা হয়। স্কুলের ছোটখাটো বিষয় সামাজিক মাধ্যমে বড় ইস্যুতে রূপ নেয়।

পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তদন্ত করা হয়। সর্বশেষ ৪ জুলাই নীলফামারীর জলঢাকায় গোলমুন্ডা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল ড্রেস না পরায় এক শিক্ষার্থী মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক মেয়ে শিক্ষার্থী ড্রেস ছাড়া স্কুলে আসে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অ্যাসেম্বলি ও জাতীয় সঙ্গীত শেষে ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক অলিয়ার রহমান প্রথমে ওই শিক্ষার্থীকে কান ধরে তিন-চার মিনিট উঠবস করান এবং অশালীন ভাষা ব্যবহার করে মানসিক নির্যাতন চালান।

এ সময় মানসিক চাপে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ওই শিক্ষার্থী। খবর পেয়ে শিক্ষার্থীর বাবা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করান এবং দুই দিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। এ ঘটনার পর থেকে লজ্জায় স্কুলে আসতে চাইছে না ওই শিক্ষার্থী।

এদিকে গতকাল বুধবার নীলফামারীর জলঢাকায় স্কুল ড্রেস না পরায় শিক্ষার্থী মানসিক নির্যাতনের ঘটনা তদন্ত করে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১০ আগস্ট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার চঞ্চল কুমার ভৌমিক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেয়া হয় গোলমুন্ডা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নানকে। স্কুল ড্রেস না পরায় শিক্ষার্থী নির্যাতনের জবাব চাওয়া হয় ওই চিঠিতে।

এ বিষয়ে গোলমুন্ডা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টি তেমন কিছু না। ওই শিক্ষার্থী অ্যাসেম্বলির অনেক পরে স্কুলে আসে এবং তার পাজামাটা ড্রেসকোড ছিল না। এ জন্য সহকারী শিক্ষক তাকে একটু বকাঝকা দিয়েছে এবং কানে ধরে উঠবস করিয়েছে।

ওই সময় স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন না জানিয়ে আরও বলেন, আমি ঘটনা শোনার পর সহকারী শিক্ষককে সতর্ক করেছি। আর ওই ছাত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল যার জন্য বিষয়টি একটু খারাপ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা অফিসার তদন্তের জন্য চিঠি দিয়েছেন। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার চঞ্চল কুমার ভৌমিক বলেন, শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাটি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান শিক্ষককে চিঠি দেয়া হয়েছে।

নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর বাবা বলেন, আমরা গরিব মানুষ আমাদের অনেক সময় সমস্যা হয়। স্যারদের আরও নমনীয় হওয়া উচিত। এ ঘটনা পরবর্তীতে যেন আর কারো সাথে না ঘটে। 

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক উইং) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের কাছে গুরুতর অভিযোগ এলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

মাধ্যমিকের পরিচালক বলেন, প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের একটা নিজস্ব ড্রেসকোড থাকে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এটি কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল, এর কোনো নির্দেশনা ছিল না। শুধু মৌখিক নির্দেশনা ছিল। যেহেতু করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকেই খুবই বিপদের মধ্যে ছিল। এখন বিষয়গুলো আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’

তিনি বলেন, আমাদের বলায় আছে— শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাই নমনীয় আচরণ করবে। এখানে আক্রমণাত্মক আচরণ করার কোনো সুযোগ নেই, এর জন্য পরিষ্কার বিধিবিধান আছে। তা যদি কেউ লঙ্ঘন করে নিশ্চয় তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়াও পত্রিকা, অনলাইনের কোনো নিউজ আমাদের নজরে এলে এবং কেউ অভিযোগ করলে সেই আলোকে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’