গ্যাস সংকট : জ্বলে না চুলা

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২২, ০১:২২ এএম

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী দ্বীপ সাহা। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময়ে দুপুরে খাবার নিয়ে যান। কিন্তু গত দুই মাস তার ব্যত্যয় ঘটছে। তীব্র গ্যাস সংকটে দুই বেলা রান্না করা খাবার খেতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাস দুয়েক আগে থেকেই চুলায় গ্যাসের চাপ কম ছিল।

এরপরও বাসায় রান্নাবান্না করা যেত। এখন সারা দিনে মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা গ্যাস থাকে। তাও মধ্য রাত একটা থেকে তিনটা-চারটার আগেই আবার গ্যাস শেষ হয়ে যায়। বাচ্চাকে সময় মতো সুজি, নুডলস রান্না করা করে খাওয়ানো এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।

তিনি তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাননি। পরে তিনি তিতাসের জনসংযোগ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, গ্যাস সংকট বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে তিতাসের ওয়েব সাইটে অভিযোগ করতে হবে। তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নেবেন। এছাড়া তিনি ওয়েব সাইটে দেয়া হটলাইনের সাহায্য নিতে বলেন। এদিকে ভোক্তভোগী হটলাইনের সবকটি নাম্বার বন্ধ পান।

পরে তিনি তিতাসের স্থানীয় পোস্তগোলা জোনে ফোন দিয়েও কোনো সদুত্তর পাননি। আর না পেলেন সমাধান। এভাগে চলছে ভোক্তভোগীদের হাহাকার। তিতাসের নেই কোনো আশ্বাস। প্রতি মাসে গ্রহণ এক চুলায় ৯৯০ টাকা এবং দুই চুলায় ১০৮০ টাকা গুনতে হয়। দিনের তিন-চার ঘণ্টার বেশি গ্যাস না থাকলেও প্রতি মাসে ঠিকই বিল পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সাধারণ গ্রাহকদের অভিযোগ আমরা গ্যাস ব্যবহার না করেও প্রতি মাসে বিল গুনতে হয়। অথচ চুলায় গ্যাস না থাকায় আমাদেরকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। রান্নার জন্য প্রতি মাসে সিলিন্ডার গ্যাসে অতিরিক্ত ১৫০০-২০০০ টাকা খরচ হচ্ছে আমাদের। মুগদার রত্না বেগম জানান, গ্যাস না থাকায় আমি রাইস কুকার ব্যবহার করি। আবার কেউ কেউ ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করে থাকেন।

কেউ বা রীতিমতো উচ্চমূল্যে হোটেলের খাবার খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। নবীনগরের আফলাতুন কাওসার জানান, তার বাসায়ও গ্যাস থাকে না। ভোর ছয়টার আগেই গ্যাস চলে যায়। এজন্য তার বাসায় বুয়া ফজরের আগেই চলে আসে।

মেরুল বাড্ডার বাসিন্দা রাহেলা খাতুন আমার সংবাদকে জানান, এখন রান্নাবান্নায় অনেক ভোগান্তি হয় আমাদের। সকাল-দুপুরের খাবার রান্নার জন্য রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। কারণ ভোর ৫টার আগেই গ্যাস চলে যায়। দিনে ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করি মাঝে মাঝে। এখন আবার লোডশেডিংয়ের ফলে ইলেকট্রিক চুলাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যার কারণে বাইরে থেকে খাবার কিনে খান তিনি। লাইনে টিপ টিপ করে গ্যাস আসায় রান্নাবান্না বন্ধের উপক্রম। অনেক গৃহবধূ চুলায় হাঁড়ি চড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে গ্যাস আসার অপেক্ষা করছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকা যেমর- মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মগবাজার, যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়ায় এমন প্রশ্ন শত শত মানুষের। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধ করেও প্রয়োজনের সময় গ্যাস পাচ্ছি না। তিতাস গ্যাস কর্মকর্তারা বলছেন বেশ কিছু দিন যাবত রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ, আবাসিকে চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া আসন্ন শীতের কারণে বিভিন্ন লাইনে গ্যাস জমে যাওয়ায়ও স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।

গ্যাস সংকটের কারণে এখন রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চুলা জ্বলছে না। একই পরিস্থিতি শিল্পে। গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক সময়ের মতো কারখানা চালানো যাচ্ছে না, কমছে শিল্পের উৎপাদন। পরিবহন খাতও ভুগছে গ্যাস সংকটে। দেশে দিনে মোট ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখন পারছে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। কারণ, চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ আড়াই মাস ধরে। গ্যাস সংকটের কারণে অনেকে মাটির চুলায় রান্না করছেন।

ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সাজেদা বলেন, কয়েক দিন ধরে দিনের বেলায় চুলা জ্বালানোই যাচ্ছে না। ভোরের দিকে এবং রাতে গ্যাস পাওয়া যায়। বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করতে হয়। তিনি বলেন, এলপিজি সিলিন্ডারও কিনতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেন, সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি আছে, এটা ঠিক। সারা বিশ্বেই গ্যাসের সমস্যা এখন। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে। দেশে দুভাবে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত এবং আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে। দিনে দেশি গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস সরবরাহ করা হতো ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো।

আর এলএনজি আমদানি হতো ৭০ থেকে ৭৫ কোটি ঘনফুট। এখন এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে ৪৮ কোটি ঘনফুট। বিশ্ববাজার থেকে এখন পর্যাপ্ত এলএনজি কিনতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ, দাম অত্যন্ত চড়া। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এলএনজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। রাশিয়ার গ্যাস না পেয়ে ইউরোপের দেশগুলো খোলাবাজার থেকে কিনছে। এতে দরটি বাংলাদেশের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরকারও খোলাবাজার থেকে চড়া দামে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে এলএনজি আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এ কোম্পানির

সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজি কার্গো (জাহাজ) আনা হচ্ছে। এতে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম পড়ছে এখন প্রায় ১৫ মার্কিন ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এই দর ছিল ১০ ডলারের কম। আর সিঙ্গাপুরের খোলাবাজার থেকে কেনা এলএনজি নিয়ে প্রতি মাসে তিনটি করে জাহাজ আসার কথা। এখন বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৬০ ডলারের বেশি। গত জুনেও তা ৩৬ ডলারে ছিল। গত বছর নেমেছিল চার ডলারে। পেট্রোবাংলার কাছ থেকে নিয়ে গ্রাহকপর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ করে দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থা। এ সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুসারে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। গ্রাহকরা নিয়মিত অভিযোগ করছেন। কিন্তু তারা কোনো সমাধান দিতে পারছেন না। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে গ্যাস সরবরাহ করে দেশের শীর্ষ গ্যাস বিতরণকারী সরকারি কোম্পানি তিতাস গ্যাস। এখন দিনে ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে তিতাস পাচ্ছে ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। ফলে তারা গ্রাহকদের গ্যাস দিতে পারছে না। গ্রাহকরাও দিনভর ফোন করছেন তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি আছে, এটা ঠিক। সারা বিশ্বেই গ্যাসের সমস্যা এখন। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তিনি বলেন, দাম সহনীয় হলে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে সরকার। এখন দেশি উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল বলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির চাহিদা বাড়ছে। দাম আরও বাড়তে পারে। তাই পরিস্থিতির আপাতত উন্নতির সম্ভাবনা নেই। তিনি আরও বলেন, অবশেষে সরকার দেশে উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে, যা পাঁচ বছর আগেই করা উচিত ছিল। তবে রাতারাতি গ্যাস পাওয়া যাবে না। আমদানিনির্ভরতা ভুল নীতি ছিল। তাই এখন ভুগতেই হবে, এটা কৃতকর্মের ফল।