জ্বালানির ভর্তুকিতে শর্ত

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২২, ১২:৫৫ এএম

অর্থনীতির ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ ও ডলার ঘাটতি সমন্বয়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার আবেদন করে সরকার। প্রটোকল অনুযায়ী সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন একটি দল গত মাসের শেষের দিকে দেশে আসে। পক্ষকালব্যাপী এ সফরে প্রতিনিধি দল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বৈঠক করছে। বৈঠকে তারা ভর্তুকি খাতে সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়েছে।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তৈরি করার তাগিদ দেন তারা। এমতাবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, আইএমএফের শর্তানুযায়ী সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম ইতোমধ্যে বাড়িয়েছে। এখন ভর্তুকি কমিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ালেই আইএমএফের প্রধান শর্তও বাস্তবায়ন হবে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে আইএমএফের ঋণ বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। তাই ভর্তুকি কমিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জোর সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকটে পড়েছে দেশ। এই সংকট সাময়িক দূর করার জন্য সরকার আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য তোড়জোড় চলাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকার আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সাথে দফায় দফায় করেছে। তারা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবারই শর্ত দিয়ে থাকে। তবে এবার ভর্তুকির পরিমাণ কমলেও বিদ্যুতের দাম বাড়বে কি-না সেটি নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না। কারণ দেশ এমনিতেই অর্থনৈতিক চাপে আছে। আমরা আগেও দেখেছি তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি কীভাবে বেড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে লোকসান সামলাতে না পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। যা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ঠেলে দেবে।

বিপিসিকে সরকারের ভর্তুকির ওপর চাপ কমিয়ে বিশ্ববাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে বলেছে আইএমএফ। সম্প্রতি বিপিসি কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে আইএমএফের সফরকারী দলটি এসব কথা জানায়। বিপিসি সূত্র জানায়, আইএমএফ দল বিপিসির আর্থিক সক্ষমতা এবং ক্ষতি ও লাভের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। পাশাপাশি কীভাবে জ্বালানি তেলের বিষয়টি পরিচালিত হয় সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, বৈঠকে তারা পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাসের বর্তমান চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতির পাশাপাশি এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চায়। তারা এলএনজির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এবং ভর্তুকি সংক্রান্ত বিষয়েও জানতে চেয়েছে। তার আগে পিডিবি এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে বৈঠক করে আইএমএফের দলটি। সে সময় বিদ্যুতের ভর্তুকি কমাতে পিডিবিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়ে জানতে চায় আইএমএফ। একই সাথে তারা কুইক  রেন্টাল এবং ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়ে কথা বলেছে।

সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের ঋণ পেতে এই শর্তগুলো স্বল্পমেয়াদে বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে। বাকি শর্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের অঙ্গীকার চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আইএমএফ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি সেক্টরের ভর্তুকির পরিসংখ্যান, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি আমদানির প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে।

আইএমএফের মতে, ভর্তুকির বড় একটি অংশ বরাদ্দ দেয়া হয় ঋণ থেকে। যা গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে এনে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে দাম বাড়ানো না হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের জন্য আসন্ন অর্থবছরে ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। যা চলতি বছরের চেয়ে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ খাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যা বিগত কয়েকটি অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৯২০ কোটি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৮ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।

এদিকে আইএমএফ প্রতিনিধি দল দেশে আসার আগেই জুন মাসে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২৩ শতাংশ ও এলএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করা হয়। এ ছাড়া আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম ৪৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এ কারণে বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবি। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপ ও মানুষের জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। আইএমএফের পর্যালোচনা, মন্তব্য ও শর্ত অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম কত বাড়তে পারে এ ব্যাপারে সঠিক বলতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিইআরসির বিদ্যুৎ-বিষয়ক সদস্য মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, বিদ্যুতের ভর্তুকির বিষয়ে চলতি সপ্তাহে আমরা আইএমএফের সাথে আলোচনায় বসব। সামঞ্জস্য বজায় রেখে ভর্তুকির পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসবে। তবে দাম বাড়বে বা কমবে কি-না এটি নির্ভর করছে সরকার কতটুকু ভর্তুকি রাখবে তার ওপর।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘সরকার ইতোমধ্যে দাম সমন্বয় করেছে। দাম সমন্বয় করতে গিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করেছে ৫০ শতাংশ। এলপি দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এখন আবার কেন জ্বালানির দাম বাড়বে এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিদ্যুতের দাম বাড়ানের সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, সমপ্রতি আইএমএফের কাছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। এই সহায়তা চাওয়ার পর আইএমএফ অর্থনৈতিক নানা খাতে সংস্কারের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে জ্বালানি ও বিদ্যুতে ভর্তুকির বিষয়েও আলোচনার কথা জানায় আইএমএফ।