হজযাত্রীদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ

জাহিদুল ইসলাম প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২২, ০১:১৭ এএম

ইসলামের প্রধান পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হজ। প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কায় হজের উদ্দেশে একত্রিত হয়। এই হজ কার্যক্রমকে ঘিরে এবার প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে হলি এয়ার সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদিসের ঢাকা মহানগরীর নেতা ও পুরান ঢাকার বংশাল পেয়ালাওয়ালা মসজিদের খতিব মো. এহসান উল্লাহ।

পুণ্যার্থীদের উন্নত সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে অধিক টাকা আদায় করলেও বাস্তবে নোঙরা আবাসন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার ব্যবস্থা করে টাকা হাতানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে কয়েকজন যাত্রী লিখিত অভিযোগ করলেও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকায় সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগীরা।

করোনার আগে বিশ্বব্যাপী হজযাত্রী সংখ্যা ২৫ লাখ ছাড়িয়েছিল। বাংলাদেশ থেকেও প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ হজের উদ্দেশ্যে সৌদি গমন করেন। কিন্তু করোনাকালে বিধিনিষেধ থাকায় ২০২০ এবং ২০২১ সালে বন্ধ ছিল এই কার্যক্রম। চলতি বছরের এই বিধিনিষেধ উঠিয়ে দিলে ফের হজের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ থেকে এ বছর ৫৭ হাজার জনকে হজের  অনুমতি দেয় সৌদি আরব। চলতি বছরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে হজে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান। সরকারিভাবে মাত্র ৫৯ হাজার টাকায় ব্যবস্থা হলেও একটু ভালো আবাসন, খাবার ও পরিবহন ব্যবস্থার জন্য অনেকেই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যেতে চায়।

এরই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করে এজেন্সিগলো। এদের মধ্যে হলি এয়ার এজেন্সি (হজ লাইসেন্স নং-৯৩৮) ছয় লাখ ৫৯ হাজার এবং পাঁচ লাখ ৫৯ হাজার টাকায় ‘এ’ এবং ‘বি’ ক্যাটাগরির প্যাকেজ ঘোষণা করে। সরকারি খরচের চেয়ে এই ব্যয় প্রায় আট থেকে ১১ গুণ বেশি। যদিও ২০২০ সালে একই প্যাকেজের মূল্য ছিল যথাক্রমে চার লাখ ৬৫ হাজার ও তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা। তবে উচ্চ দরে এই প্যাকেজ ঘোষণা করলেও প্যাকেজে উল্লিখিত সুবিধা দেয়া হয়নি গ্রাহকদের।

অভিযোগকারীদের বরাতে জানা গেছে, হলি এয়ার সার্ভিস ‘এ’ প্যাকেজ যাত্রীদের মক্কায় বাইরে ২০০ গজ সীমার মধ্যে চারতারকা বিশিষ্ট হোটেলে রাখার কথা বললেও বাস্তবে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে অতি নিম্নমানের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে। অধিকাংশ রুমের দরজা-জানালার হাতল, লক, এসি ইত্যাদি নষ্টের পাশাপাশি টয়লেটে পানি ও টিস্যুর ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি সেখান থেকে মক্কায় যেতে যানবাহনের তেমন ভালো ব্যবস্থাও ছিল না বলেও জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। ফলে অনেকেই ব্যক্তিগত টাকা খরচ করে এবং পায়ে হেঁটে হারাম শরিফে জুমা আদায়ের উদ্যোগ নেয়। আবার খাবার খেতেও চরম অব্যবস্থাপনা শিকার হন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

তারা বলেন, প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে আমাদের ঠেলাঠেলি করে খাবার সংগ্রহ করতে হয়েছে। আবার পর্যাপ্ত বসার জায়গা না থাকায় অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবার খেয়েছে। তা ছাড়া হজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের নিয়মিত ফ্রিজের মাংস, রুই মাছ, রুটি-কলাসহ যে সব খাবার সরবরাহ করা হয়েছে তা অনেকেই খেতে পারেনি।

তারা আরও বলেন, আমাদের থেকে বেশি মূল্যে ‘এ’ প্যাকেজের নামে যে সেবা দিয়েছে অন্যান্য এজেন্সিগুলো সেগুলো ‘বি’ প্যাকেজ ধরে তাদের গ্রাহকদের সার্ভিস দিয়েছে। এখান থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, হলি এয়ার সার্ভিস হজযাত্রীদের ভালো সুবিধা দেয়ার নামে মূলত তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। সে সময় বিষয়টি নিয়ে হজ যাত্রীরা মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ জানালে সরেজমিন পরিদর্শন করে তিনজন কর্মকর্তা। পরিদর্শনের ভিত্তিকে পরবর্তীতে তারা এজেন্সির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। হাজীদের সাথে এমন প্রতারণায় সরকারের হজ ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে হলি এয়ার সার্ভিস, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টি অতিরাষ্ট্রীয় বিবেচনায় ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে হলি এয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে কেন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা জানতে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। গত ২২ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কাশেম মোহাম্মদ শাহীন স্বাক্ষরিত এ শোকজ নোটিস দেয়া হয় হজ এজেন্সিকে। শোকজের সাত দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হলেও গত ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো জবাব দেয়নি হলি এয়ার সার্ভিস। অবশ্য গত ২৯ সেপ্টেম্বর ইসলামি ফাউন্ডেশন ভবনে দুই পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানির আয়োজন করা হয়। এ সময় সেখানে অভিযোগকারীদের পক্ষ থেকে ছয়জন উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়াও এজেন্সির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মো. এহসান উল্লাহ। কিন্তু শুনানি চলাকালীন ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইয়াকুব আলী জুলামাতির সাথে অভিযুক্ত এহসান উল্লাহর দহরম-মহরম সম্পর্কে নিশ্চত হওয়ায় তা অভিযোগকারীদের সুষ্ঠু বিচারের বিষয়ে শঙ্কায় ফেলেছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দেয়ায় একটি বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়— জাস্টিস ডিলেই, জাস্টিস ডিনাইড।

এমনটা হলে হজের মতো একটি পবিত্র কার্যক্রমে প্রতারণার দায়ে বহির্বিশ্বে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টজনরা। তবে বিলম্বের বিষয়ে উপসচিব আবুল কাশেম মোহাম্মদ শাহীন দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা বলতে পারব না। আমাদের শুনানি এখনো চলমান। শুনানি শেষ হলে রিপোর্ট দেয়া হবে।

তিনি বলেন, হাজীদের এই অভিযোগগুলোকে সহজভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এর সাথে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা জড়িত। এ ধরনের ঘটনা সরকারের হজ ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হাজীদের এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় হলি এয়ার সার্ভিসের স্বত্ব্বাধিকারী এহসান উল্লাহর জামাতা ও ম্যানেজার মুহাম্মাদের কাছে।

তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব সেবা দিয়েছি। এখন তারা কেন মিথ্যা বলছেন সেটি বলতে পারব না।’ তবে ফোর স্টার হোটেলের সামনে ময়লার ভাগার এবং টয়লেটে লক ও পানির লাইন ভাঙার বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি কোনো জবাব দেননি।