বিজয় ছাড়া ঘরে ফিরব না

মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২২, ০১:২৮ এএম

 

আউলিয়ার শহর সিলেটে ব্যাপক শোডাউন করে নিজেদের শক্তি জানান দিয়েছে বিএনপি। পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে গতকাল শনিবার সপ্তম বিভাগীয় গণসমাবেশে যোগ দেন নেতাকর্মীরা।

নগরের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে গণসমাবেশে প্রধান অতিথি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এই দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করবে তাদের চিহ্নিত করা হবে। তারা গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক শ্রমিক কিন্তু এখন শান্তিতে নেই। গতকালও চিনির দাম, তেলের দাম বেড়েছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। মানুষ এখন খেতে পারে না। তিন কোটি মানুষ বেকার। অথচ তারা ১০টাকা দামে চাল খাওয়াবে বলেছিল।

মির্জা ফখরুল বলেন, গত  ১৪ বছরে এই সরকার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে। এই সরকারের বিচার হবে জনগণের আদালতে। মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেয়ার অপরাধে এই বিচার হবে।’

বিএনপি মহাসচিব সমাবেশে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সিলেট থেকে শুরু হলো। এই সিলেট থেকেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান এই স্বৈরচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ফেরাতে এই সিলেট থেকেই আবার যুদ্ধ শুরু হলো।’

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নির্দলীয় সরকারের দাবি অদায় এবং চলমান আন্দোলনে পাঁচ কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। নগরের আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে বেলা ২টায় এ সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুরআন তিলাওয়াত ও মুনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। 

বেলা দেড়টার দিকে মঞ্চে উঠেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঞ্চে একাধিক বক্তা দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন দাবি করেন।

গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গণপরিবহন ধর্মঘট ডাকায় কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল সিলেট। মোটরসাইকেল, ট্রেন, ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও পায়ে হেঁটে বিভাগের চার জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দেন।

এদিকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। রিকশার পাশাপাশি পায়ে হেঁটে অনেকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছান। সিলেট নগরে  সকাল ৯টার পর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বিঘ্ন ঘটে বলে অনেকে জানান। মোবাইল অপারেটর সূত্রে জানায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি থেকে দ্রুতগতির মোবাইল ইন্টারনেটসেবা বন্ধের নির্দেশ পেয়েছে তারা।

এদিকে গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে নগরের প্রবশমুখ ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বসানো হয় তল্লাশি চৌকি। ভোরের আলো ফুটতেই জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে যোগ দেন। 

সেখানে আসার পথে কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দেয় বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। বেলা ১২টার আগে আলিয়া মাদ্রাসা ময়দান লোকেলোকারণ্য হয়ে যায়। একপর্যায়ে জনস্রোত মাঠ ভরে আশপাশের সড়কে গিয়ে ঠেকে। মাঠে জায়গা না পেয়ে আশপাশের সড়কগুলোতে অবস্থান নেন নেতাকর্মীরা। মাঠে প্রচণ্ড রোদ থাকায় অনেকে আশপাশের গাছের নিচে অবস্থান করেন।

গণসমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকার এখন মামলা খেলা করছে। কোনো কিছুই ঘটেনি। তবু তারা নাশকতার কথা বলে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। আবার হুমকি দেয়, হেফাজতের মতো অবস্থা হবে।’ তিনি বলেন, আমি বলতে চাই, ‘হুমকি ধামকিতে কাজ হবে না। জনগণ আজ জেগে উঠেছে। জনগণ বিজয় ছাড়া ঘরে ফিরে যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, সারা দেশের মানুষের দাবি এক, দফা এক— বর্তমান জালিম সরকার শেখ হাসিনা পদত্যাগ। এ সমাবেশ থেকে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানাই— সবাই ঐক্যবব্ধ হয়ে বর্তমান স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 

প্রধানমন্ত্রী কেবল সংবিধানের দোহাই দেন উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই সংবিধান তো তিনি সংশোধন করিয়েছেন। এই সংবিধান আমরা মানি না। আর যদি একটি মিথ্যে মামলা দেয়া হয় তবে জনগণ তা প্রতিহত করবে।’

ফখরুল বলেন, ‘আমরা দেশে শান্তি চাই। অশান্তি চাই না। আমাদের দাবি এক— সরকারের পতন চাই। রাজপথেই এর ফায়সালা হবে। এই দানবীয় সরকারকে পরাজিত করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই অভিলম্বে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। মধ্যবর্তী সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। ‘সব দলকে আমরা আহ্বান জানাই, আসুন আমরা একাত্তরের মতো এক হই। এই দানবীয় সরকারকে সবাই মিলে পরাজিত করি।’

ক্ষমতায় গেলে কী করা হবে— এ প্রসঙ্গে কিছু অঙ্গীকার করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, রাষ্ট্র মেরামত করতে বিচার বিভাগে সংষ্কার করা হবে। দুর্নীতি বন্ধ করা হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হবে। দেশে মানবাধিকার ফিরিয়ে আনা হবে। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী ও মহানগরের সদস্য সচিব মিফতাহ সিদ্দিকীর যৌথ সঞ্চালনায় গণসমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। বিশেষ অতিথি ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

আরও বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, ব্যারিস্টাার মাবুবউদ্দি খোকন, তাহসীনা রুশদীর লুনা, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবুল কাহের চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরীও শাম্মী আক্তার, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, তাঁতীদলের সভাপতি আবুল কালাম, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সভাপতি হারুন আল রশীদ, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল, জাসাস সাধারণ সম্পাদক হেলাল খানসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতা।

আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের খেলা হবে— প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আওয়ামী লীগ শুধু খেলার ডাক দেয়। তবে তারা তো দরজা বন্ধ করে খেলায় পারদর্শী। যে কারণে যখন পাপিয়া-পরীমণিরা ধরা পড়ে তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের বুক ধড়ফড় করে। বিএনপি আনাড়ি খেলোয়াড়দের সাথে খেলে না। খেলা শিখে আসেন। নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে খেলেন। শেখ হাসিনাও জামানত হারাবেন।

গয়েশ্বর বলেন, যত টাকা ঋণ করা হয়েছে সেই টাকার সুদ দেয়ার মতো টাকাও কোষাগারে নেই। সরকার লুটে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকার ধর্মঘট ডেকে গণপবিরহন চলাচল বন্ধ করে এসব সমাবেশ ঠেকাতে চায়। সরকারকে একদিন জবাব দিতে হবে— এসব ধর্মঘট ডেকে প্রতিদিন দেশের কত কোটি টাকার ক্ষতি করছে।

সিলেটবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে অন্যায়, অত্যাচার জুলুমম, নির্যাতন চলছে। আজ বলতে চাই বাংলাদেশে আর কোনো জুলুম অত্যাচার চলবে না। আমরা দেশে আবার গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো, যেমন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। আমরা জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দেবো। দিনের ভোট আর রাতে করতে দেয়া হবে না।’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আজকের এই সমাবেশ প্রমাণ করছে সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা নেই। মানুষ আজ রাস্তায় নেমে এসেছে। দেশ যাবে কোন পথে, ফায়সালা হবে রাজপথে। সিলেটে গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে গণপরিবহন ধর্মঘটে চরম ভোগান্তি শিকার হন যাত্রীরা। বাস বন্ধ থাকায় অনেকে জরুরি প্রয়োজনে ঢাকা ও আশপাশের জেলা উপজেলায় যেতে পারেননি। বাস না পেয়ে অনেকে টার্মিনাল থেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। কেউ কেউ রিকশা, অটোরিকশা ভেঙে ভেঙে ও পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যান।

মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বিঘ্ন : সিলেট নগরে সকাল থেকে থ্রিজি ও ফোরজি ইন্টারনেটসেবা বন্ধ ছিল। গ্রাহকেরা জানিয়েছেন, সকাল ৯টার পর থেকে তারা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন না। মোবাইল অপারেটর সূত্রগুলো জানায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশেই তাদের সেবা বন্ধ রাখতে হয়। সিলেটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা থ্রি-জি ও ফোর-জি সেবা বন্ধের নির্দেশ পেয়েছে।

ছাত্রলীগের শোডাউন : গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টায় ছাত্রলীগের এক মোটরসাইকেল শোডাউন বিএনপির সমাবেস্থল সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ এলাকা অতিক্রম করে। ২০ থেকে ২৫টি মোটরসাইকেল বহর নিয়ে জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ চৌহাট্টা এলাকা অতিক্রম করেন। এ সময় পথচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।