সংকটেও গ্যাসের সিস্টেমলস

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২২, ০১:০৭ এএম

দেশে তীব্র গ্যাস সংকট। চলমান ঘাটতির মধ্যেও বেড়েই চলছে সিস্টেম লস। অপচয়, অপব্যয় আর অবৈধ সংযোগের নামে হচ্ছে পুকুরচুরি। এছাড়া কারিগরি ব্যবস্থাপনায়ও অপচয় অব্যাহত রয়েছে। কারিগরি অপচয় বন্ধ হলে অন্তত ৬০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস আমদানি ঠেকানো সম্ভব। পাশাপাশি উন্নয়নকাজে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে লাইন ফুটো হয়ে অপচয় হচ্ছে বিপুল গ্যাস। বর্তমানে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করেছে সরকার।

ফলে দৈনিক ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। এতে দেশের বিদ্যুৎ, শিল্প ও আবাসিক খাতে প্রচণ্ড সংকট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বাধ্য হয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এতকিছুর পরও গ্যাসের সিস্টেম লস বাড়ছে। সিস্টেম লসের বড় কারণ অবৈধ সংযোগ। এছাড়া কারিগরি ব্যবস্থাপনার কারণে লিকেজ লাইন দিয়ে বিপুল গ্যাস অপচয় হচ্ছে।

এছাড়া জনসচেতনতার অভাবেও অপচয় হচ্ছে গ্যাস। পাশাপাশি অধিকাংশ আবাসিক লাইনে মিটার না থাকায় গ্রাহকের বাড়ছে ভোগান্তি। গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত গ্যাস। সারা মাস গ্যাস অপচয় না করলেও মাস শেষে দিতে হয় হয় নির্ধারিত (ফিক্সড) বিল। মিটার না থাকায় ৩০ ঘনফুট গ্যাসের অতিরিক্ত দাম দিতে হয় গ্রাহককে। ফলে গ্রাহক অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অজুহাতে গ্যাস অপচয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, দেশে বৈধ ৩৮ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মধ্যে তিন লাখ ৬৮ হাজার প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহক ন্যায্য দামে পাচ্ছে গ্যাস। বাকি সাড়ে ৩৪ লাখ গ্রাহক অর্থাৎ ৯০ শতাংশ গ্রাহকের পকেট কাটা হচ্ছে। এই চুরির প্রায় পুরোটাই বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অধিভুক্ত এলাকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অবৈধ সংযোগের ফলে চুরি হওয়া গ্যাসের পুরোটাই চালিয়ে দেয়া হচ্ছে সিস্টেম লস নামে। বিতরণ কোম্পানিগুলো নিয়ম করে ওই অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকে নিচ্ছে। অথচ আবাসিকে যে পরিমাণ গ্যাস দিয়ে বিল নেয়ার কথা তা করা হচ্ছে না। শিল্পে যে চাপে গ্যাস দেয়ার কথা তাও দেয়া হচ্ছে না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গ্রাহক ঠিকই অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন। আশঙ্কার বিষয় হলো, গোটা বিষয়টিই একটি সিস্টেমের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। সিস্টেম লসের গ্যাস কোথায় এবং 
কীভাবে নষ্ট হয়, তার প্রকৃত কারণ জানা জরুরি। গ্যাস সংকটের সময় সিস্টেম লস বৃদ্ধি অবশ্যই রোধ করতে হবে। মূলত গ্যাস বিতরণকালে কারিগরি, টেকনিক্যাল ও অন্যান্য কারণে যে গ্যাস নষ্ট হয় তাকেই সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত ক্ষতি বলা হয়। গ্রাহকের কাছে গ্যাস পৌঁছতে আদর্শ সিস্টেম লস ধরা হয় ২ শতাংশের নিচে, সর্বোচ্চ ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে বিতরণে ২ শতাংশ ও সঞ্চালনে দশমিক ২৫ শতাংশ কিন্তু বাংলাদেশে উত্তোলন ও আমদানিকৃত গ্যাসের সিস্টেম লস প্রায় ৮ শতাংশে ঠেকেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে সেটা বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ।

জানা যায়, রাজধানী এবং আশপাশের কয়েকটি জেলায় লাখ লাখ বাসায় রয়েছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। বৈধভাবে গ্যাস সংযোগ না পেয়ে গ্রাহক অবৈধ সংযোগ নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। আর এতে সহায়তা করছেন একশ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিতাস সূত্র জানায়, সীমিত লোকবল দিয়ে সবসময় সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের কাজ চালানো যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর সিস্টেম লস, অনিয়ম, অদক্ষতা, অপচয় ও দুর্নীতি দূরীকরণে মনোযোগ দিলে সংকট মোকাবিলা সহজ হবে। সরকারের উচিত চুরি বন্ধ করা। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণ গ্যাসের বিল নেয়া হয়, প্রকৃতপক্ষে তার থেকে কম মূল্যের গ্যাস ব্যবহার হয়, কিন্তু গ্যাস চুরি বন্ধ না করে বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে ভুগতে হচ্ছে।

সূত্র জানায়, গ্যাসের সিস্টেম লস বিগত ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সবচেয়ে বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্যাসের যে সিস্টেম লস ছিল তা ২০১৯-২০ থেকে বেড়ে প্রায় পাঁচ গুণ হয়েছে। ওই ধারা ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলমান ছিল।

বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, গৃহস্থালি রান্নায় ব্যবহূত দুই চুলার একজন গ্রাহক মাসে গড়ে কোনোভাবেই ৫০ ঘনমিটারের বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন না। অথচ ৭৮ ঘনমিটার ধরে দুই চুলার বিল হিসাব করা হয়েছে এক হাজার ৮০ টাকা। তার মানে প্রতি চুলায় একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ২৮ ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়তি নেয় বিতরণ কোম্পানি। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী একজন গ্রাহক ৪০ থেকে ৪৫ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন। তাদের মাসে বিল দিতে হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। মিটার ছাড়া একজন গ্রাহক মাসে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়তি বিল দিচ্ছেন বিতরণ কোম্পানিকে। শুধু তিতাসের আবাসিক গ্রাহক আছেন সাড়ে ২৮ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে ২৫ লাখের বেশি গ্রাহকের প্রিপেইড মিটার নেই। এর ফলে এসব গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত ১১৫ কোটি টাকা বাড়তি নিচ্ছে তিতাস। এতে ১১৫ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হিসাবে খাতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, দেশে আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানিগুলোর (আইওসি) কাছ থেকে প্রায় তিন ডলার করে প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাস কেনা হচ্ছে। ওই হিসাবে প্রতি বিসিএফ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৩২ কোটি টাকার কিছু বেশি। ফলে সিস্টেম লস হওয়া ২১৮ বিসিএফ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, সিস্টেম লসের নামে ওই চুরি কমানো গেলে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি করার প্রয়োজন পড়তো না।

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা জানায়, সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। তার মাধ্যমে ব্যাপক হারে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ক্যাব বলেছে, সরকার বারবার জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করছে। আমাদের গ্যাস চুরি ঠেকানো গেলে দাম বাড়ানোর আর দরকার হয় না। অস্বাভাবিক সিস্টেম লসের নামে পুকুরচুরি কমানো গেলেও দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, সামগ্রিকভাবে ৮ শতাংশের ওপর সিস্টেম লস দেখানো হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের ওপর সিস্টেম লস নেই। দৈনিক কমবেশি তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের পাইপলাইনে দেয়া হচ্ছে। এখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অন্যদিকে স্পর্ট মার্কেট থেকে গড়ে মাত্র ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে যে গ্যাস টুকুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে যে পরিমাণ গ্যাস ৫-৬ ডলারে পাওয়া যেতো এখন সেই গ্যাস কিনতে হচ্ছে ৩১ ডলার দিয়ে। চুরি যদি ৩ শতাংশ কমানো যায় তাহলেও স্পট মার্কেট থেকে চড়া দামে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করতে হয় না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, চুরি ছাড়া গ্যাস অপচয়ের তেমন সুযোগ নেই। অবৈধ গ্রাহকদের মাধ্যমে এটি হচ্ছে। অপচয়ের বড় অংশ আসে চুরি থেকে, আর বাকিটা লিকেজ থেকে। চুরি বন্ধ করে হাজার কোটি টাকার গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিতাসে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। দুদক গ্যাস-সংযোগে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা, অবৈধ সংযোগ দেয়া, মিটার টেম্পারিং করা, কম গ্যাস সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো এবং বাণিজ্যিক গ্রাহককে শিল্প শ্রেণীর গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেয়াসহ ২২টি বিষয়কে প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতির উৎস বলে তারা চিহ্নিত করেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, চিহ্নিত দুর্নীতির উৎস বন্ধে তেমন সক্রিয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সিস্টেম লসের বোঝা সরকার ও বৈধ গ্রাহকের ঘাড়ে চাপে। এতে সরকারের ভর্তুকি ও ব্যক্তির ব্যয় বাড়ছে।

এই চুরির প্রায় পুরোটাই বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অধিভুক্ত এলাকায়। অল্প পরিমাণে রয়েছে কুমিল্লা চাঁদপুর অঞ্চলে বিতরণ কোম্পানি বিজিডিসিএল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানি কেজিডিসিএল-এ। তিতাসের চুরি এখন ওপেন সিক্রেট। কোম্পানিটি সমপ্রতি চাপের মুখে জোনগুলোকে পৃথক করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বেশকিছু জোনে পৃথক মিটার বসানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার জোনে প্রায় ৩০ শতাংশের ওপর সিস্টেম লস ধরা পড়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

২০২১-২২ সালের এক তথ্য মতে, তিতাসের বছরে বিক্রীত গ্যাসের পরিমাণ ১৫ হাজার ৬৫৭ এমএমসিএম (মিলিয়ন কিউবিক মিটার) এবং আবাসিক (বৈধ) ক্রেতার সংখ্যা ২৮ দশমিক ৫৬ লাখ। হিসাবে বাসাবাড়ির সংযোগে বছরে অপচয় আসে প্রায় ২৮৬ এমএমসিএম। একজন গ্রাহকের নন-মিটার সংযোগে বিইআরসি অনুমোদিত মাসিক গড় ব্যবহার ৭৭ ঘনমিটার ধরা হয়। সেই হিসাবে তিতাসের আবাসিক খাতে অপচয় করা গ্যাসের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার গ্রাহকের ব্যবহূত গ্যাসের পরিমাণের সমান।