কাদের নাকি নতুন মুখ

মাসুদুল হাসান অলড্রিন প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২২, ০১:০৩ এএম

শেষ মুহূর্তে সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। আর একদিন পরই অনুষ্ঠিত হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। নেতাকর্মীদের মধ্যে জোর গুঞ্জন চলছে— কে হচ্ছেন পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক। ওবায়দুল কাদেরই থাকছেন নাকি নতুন কেউ এই দায়িত্বে আসছেন— বিষয়টি এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। যদিও এর আগে কেউ সাধারণ সাম্পাদক পদে টানা দুবারের বেশি দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি।

তাই বিষয়টি নিয়ে জোর আলোচনা চলছে রাজনীতির মাঠে। কূটনীতিকদের রাজনৈতিক তৎপরতা ও অভ্যন্তরীণ মেরুকরণ মোকাবিলা, আগামী জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ সামাল দেয়া ও বিরোধী দলগুলোর বারবার মাঠ দখলের চ্যালেঞ্জ— এসব বিবেচনায় নিয়ে নতুন রানিংমেট পছন্দ করতে পারেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা, এমনটাই মনে করছেন দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকে। অভিমানী কর্মীদের দলে ফিরিয়ে এনে দক্ষ হাতে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করা ও দলের সব স্তরে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা থাকা অন্যতম একটি শর্ত হিসেবে এবার বিবেচিত হবে।

ইতোমধ্যে রাজনীতির আন্তর্জাতিক বলয় ও কূটনীতিকদের সাথে ‘বিট’ করার যোগ্যতা, নীরব চাহিদা হিসেবে উদ্ভব হয়েছে। বিগত দিনে আওয়ামী লীগের কঠিন সময়ে পরীক্ষিত ও পরিণত একজন সাধারণ সম্পাদক চান দলীয় নেতাকর্মীরা। মোট কথা, চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট-সম্ভাবনা— সব মিলিয়ে শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দেয়ার মতো একজন প্যাকেজ সাধারণ সম্পাদক খুঁজছে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী এ কথাই বলছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা না করলেও নিজেদের রাজনৈতিক তৎপরতা দিয়ে নানাভাবে প্রার্থিতা জানান দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকে। নিজ বলয়ের নেতাকর্মীদের মুখে মুখে আলোচনায় থাকছে নিজ নেতার নাম।

‘খেলা হবে’ শব্দ দুটি দিয়ে ইতোমধ্যে রাজনীতির মাঠে ভিন্ন রকম দ্যোতনা তৈরি করেছেন ওবায়দুল কাদের। এতে দলের তরুণ নেতাকর্মীদের ভেতর প্রাণ ফিরে এসেছে  বলে অনেকের ধারণা। তারা বলছেন, ওবায়দুল কাদের এখন শারীরিকভাবে ফিট, তাই দায়িত্ব দিলে তিনি তা পালনে সক্ষম। নিয়মিত বিরোধীদের সব কথার সমুচিত জবাব দিতে ন্যূনতম ছাড় দেন না ওবায়দুল কাদের। এটি তার রুটিন কাজ হয়ে গেছে। নেতাকর্মীদের অনেকেই ভাবছেন, তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব পেতে পারেন ওবায়দুল কাদের।

কয়েক ডজন নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের অধিকাংশই এখনো ওবায়দুল কাদেরের ‘উত্তম বিকল্প’ কাউকে ভাবছেন না। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক গতবারের মতো এবারও আলোচনায় আছেন। মার্জিত ব্যক্তিত্বের নেতা হিসেবে তিনি তৃণমূলে বেশ গ্রহণযোগ্য। ছাত্রলীগের শীর্ষ সাবেক নেতাদের কেউ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাবেন কি-না, এমন আলোচনায় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবিরের নানকের নাম নেতাকর্মীদের মধ্যে দারুণ আলোচিত।

দলীয় নেতাকর্মীরা বলেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের সাবেক এই চেয়ারম্যান মাঠের নেতাকর্মীদের কাছে নির্ভর করার মতো নাম। পাশাপাশি দুঃসময়ে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের নাম আওয়ামী ঘরানার রাজনৈতিক বলয়ে বেশ আলোচনায় আছে। দুঃসময়ের ছাত্রনেতা আব্দুর রহমান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সারা বছর কঠোর ভাষায় বিরোধী পক্ষের সমালোচনা করে হাইকমান্ডের নজর কেড়েছেন, তিনিও আলোচনায় আছেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।

বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম ব্যাপক জনপ্রিয় ও দক্ষ সংগঠক। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাঠের নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ আলোচিত হচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাবেক পরীক্ষিত ছাত্রনেতা নাছিম। পাশাপাশি তৃণমূলে শক্ত অবস্থান রয়েছে তার। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকে মনে করছেন, শেখ হাসিনার আস্থার জায়গায় আছেন বাহাউদ্দিন নাছিম।

সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গতবারও নানাভাবে নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ আলোচনায় ছিলেন, এবারও আছেন। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে সাবেক তুখোড় ছাত্রনেতা ও চারবারের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকের কথাও শোনা যাচ্ছে। দক্ষ সংগঠক মির্জা আজম, আফজাল হোসেন, এস এম কামালের নামও আলোচিত হচ্ছে। জাতীয় চার নেতার একজন প্রয়াত কামরুজ্জামানের ছেলে রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ও প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহম্মেদের কন্যা গাজীপুরের সাংসদ সিমিন হোসেন রিমি; সাম্প্রতিক সময়ে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে তাদের দু’জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে; তারা দু’জনই ক্লিন ইমেজের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন। নেতাকর্মীদের অনেকে প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মণির পুত্র শেখ ফজলে নূর তাপসের কথাও বলছেন। তবে তিনি ঢাকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ কিছুটা দেখভাল করছেন, এটি তার কাজের সুবিধার জন্য করছেন বলে অনেকে জানান।

গত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে পারেন, এমন আলোচনায় সরব ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র নেতা বলেন, এটি পুরোপুরি দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার একান্ত নিজস্ব বিষয়। পরিবারের সদস্যরা যেকোনো সময় দলীয় রাজনীতিতে আসতে পারেন। নেতাকর্মীরা সবসময় তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব কাউন্সিলরদের। কিন্তু তারা বরাবরই এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন সভাপতির ওপর। তাই পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, তা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের ওপর। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কে হচ্ছেন— এ ব্যাপারে এখনো কাউকে কোনো আভাস দেননি দলীয়প্রধান। আলোচনায় যাদের নাম-ই আসুক সিদ্ধান্ত হবে কাউন্সিলে।

এবার কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, এবার কমিটি গঠনে প্রতিবারের মতো কিছু নতুন মুখ আসতে পারে, পদোন্নতি পেতে পারেন অনেকে। সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়নের দাবি করছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে নব্বই দশক ও ২০০১ পরবর্তী ছাত্রনেতাদের একটি অংশকে টানলে দল বেশি শক্তিশালী হবে বলে অনেকে মনে করছেন।

এ বিষয়ে মির্জা আজম আমার সংবাদকে বলেন, আগের কয়েকটি কাউন্সিলে সাবেক ছাত্রনেতাদেরই দাবিটি ছিল, সবসময় থাকে। এবারও হয়তো এ বিষয়টি আলোচনায় থাকবে।

দলীয় অন্যান্য পদে তরুণদের প্রাধান্য দেয়ার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, তারুণ্যনির্ভর আওয়ামী লীগের কমিটি হলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে মাঠে মোকাবিলা করা সহজ হবে। কারণ, সামনের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতকে রাজপথে মোকাবিলা করতে হলে তরুণ সংগঠক অবশ্যই প্রয়োজন। এ কারণে তরুণদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে হাইকমান্ড গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক শীর্ষ নেতা ইসহাক আলী খান পান্না, বাহাদুর ব্যাপারী, অজয় কর খোকন, লিয়াকত আলী সিকদার, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, মাহমুদ হাসান রিপন ও বদিউজ্জামান সোহাগ আলোচনায় আছেন। দল ও সরকারকে আলাদা করার নীতি বাস্তবায়ন করা হলে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রিত্ব বা দলীয় পদ; যেকোনো একটি বেছে নিতে হতে পারে।

গত সম্মেলনে এর আংশিক বাস্তবায়ন করেছে আওয়ামী লীগ। সুশাসনের জন্য ক্রমান্বয়ে এই নীতিতে এগোবে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল মান্না খান এ বিষয়ে আমার সংবাদকে আভাস দেন। তিনি বলেন, দলীয় পদ ও সরকারি দায়িত্ব (মন্ত্রিত্ব) একসাথে পালন করতে গেলে উভয় ক্ষেত্রেই কাজের গতি কমে আসে। জনগণ ও দল ওই নেতার কাছ থেকে সঠিক আউটপুট পায় না। তবে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন হবে। তবে সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমকে দলে প্রয়োজন বলে নেতাকর্মীদের অনেকে মনে করছেন। পাশাপাশি সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর নামও আলোচনায় আছে।

দলীয় একাধিক নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, পদোন্নতি পেতে পারেন উপপ্রচার সম্পাদক হিসেবে সফলভাবে পরপর দুবার দায়িত্ব পালন করা মো. আমিনুল ইসলাম আমিন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, মুক্তিযোদ্ধা-বিষয়ক সম্পাদক মৃনাল কান্তি দে। তবে বিপ্লব বড়ুয়া আরেক মেয়াদে দপ্তর সম্পাদক থাকতে পারেন। কার্যনির্বাহী সদস্য শাহাবুদ্দিন ফরাজী, আনোয়ার হোসেন, আমিরুল ইসলাম মিলন এমপি, ইকবাল হোসেন অপু এমপি পদোন্নতি পেতে পারেন।