রিজার্ভের তিনগুণ বৈদেশিক ঋণ

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩, ০৩:১২ পিএম

কয়েক বছর ধরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশি দাতাগোষ্ঠী থেকে বিপুল ঋণ নিচ্ছে সরকার। ফলে বৈদেশিক ঋণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অর্থ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এতে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতির চাকা সচল হয়েছে। কিন্তু এ ঋণের সময়মতো সুদসহ কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। যা অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। অন্যদিকে দেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। তাই বৈদেশিক ঋণ ও রিজার্ভের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়ছে। ডিসেম্বর-২০২২ শেষে সর্বসাকুল্যে বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ বিলিয়ন ডলার। যা রিজার্ভের প্রায় তিনগুণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ৫ বছরে বৈদেশিক উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে চার হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে বৈদেশিক ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ১১৪ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। আর ২০২২ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩৭৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারে। আর গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল শেষে ছিল ৯ হাজার ৭৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। সে হিসাবে গত বছরে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। গত দুই ফেব্রুয়ারি আইএমএফএর ঋণের প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। ওইদিন ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক জানিয়েছেন, প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হয়েছে। তাতে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ২৬৯ কোটি ডলারে। অর্থাৎ তিন হাজার কোটি ডলার রিজার্ভের বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ ৯ হাজার কোটি ডলার বা তিনগুণ। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে রিজার্ভ থেকে

 

বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকৃত ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার যাবে। এতে নিট রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বৈদেশিক ঋণ রিজার্ভের প্রায় চারগুণ।

অন্যদিকে করোনা এবং সবশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রিজার্ভ কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চেয়ে সময় বাড়াতে ব্যস্ত সরকার ও বেসরকারি খাত। যা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, যথাসময়ে এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ৯৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের ৭৪ শতাংশ সরকারের। আর বাকি ২৬ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। গত পাঁচ বছরে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়েছে। তবে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেশি। ২০১৭ সাল শেষে সরকারের ঋণ ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সাল শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৯ বিলিয়ন ডলারে। অন্যদিকে ২০১৭ সাল শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে এটি ২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনার কারণে ঋণ পরিশোধ না করে সময় বাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। তাই এখন চাপ বেড়েছে ঋণ পরিশোধের। বারবার সময় বাড়িয়ে নেয়ার কারণে দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

জানা গেছে, বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ঋণের বেশিরভাগই বায়ার্স ক্রেডিট। গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বায়ার্স ক্রেডিট (সরবরাহকারী ঋণ)। ২০২০ সালের জুনে বায়ার্স ক্রেডিটের পরিমাণ ছিল ৪৬৮ কোটি ডলার। ২০২১ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬৩ কোটি ডলার ও ২০২২ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৯৫৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ দুই বছরে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়েছে ৫১০ কোটি ডলার বা ১০৯ শতাংশ। বায়ার্স ক্রেডিটের এ ঋণ সাধারণত এক বছরের মধ্যে শোধ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বায়ার্স ক্রেডিট হচ্ছে দেশের আমদানিকারকের বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় নেয়া ঋণ। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণ নিয়ে থাকেন। দুই ভাবে বায়ার্স ক্রেডিট নেয়া হয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার অংশ হিসাবে আমদানিকারককে বাকিতে পণ্য সরবরাহ করে, যা ঋণ হিসাবে বিবেচিত হয়। আমদানিকারককে পণ্য বুঝে পাওয়ার ছয় মাস পর ঋণ পরিশোধ করতে হয়। আবার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানিকারককে ঋণের ব্যবস্থা করে পণ্যটি সরবরাহ করেন। এতে রপ্তানিকারক অর্থ পেয়ে যান। কিন্তু আমদানিকারক পরে ব্যাংককে ঋণ শোধ করেন। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার জন্য এসব ঋণের জোগান দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ পণ্যই ভোগ বিলাসে ব্যবহূত হয়। খুব কম পণ্যই আসে শিল্পের কাঁচামাল বা সহযোগী যন্ত্রপাতি হিসাবে। সেবা খাতের জন্য কিছু পণ্য এ প্রক্রিয়ায় আমদানি হয়। তবে বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে হলে আমদানিকারক স্থানীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি সাপেক্ষে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। এ ধরনের কোনো ঋণের সুদহার ৬ শতাংশের বেশি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয় ব্যাংকগুলোর। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে এসব ঋণের মেয়াদ এক বছর আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে মেয়াদ ছয় মাস। এ কারণে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যেই এ ঋণ শোধ করতে হয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্যবসায়ীদের এই ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়।

উল্লেখ্য, সরকারের বিভিন্ন কর্পোরেশনের (পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, গ্যাস কোম্পানি, টিসিবি) বিদেশি বাণিজ্যিক ঋণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ খাতে ঋণের পরিমাণ এখন এক হাজার ১১৫ কোটি ডলার। এসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। তাই বহির্বিশ্বে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে।