ঢাকার আশীর্বাদ মেট্রোরেল

মাসুদুল হাসান অলড্রিন প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩, ১১:২৮ এএম

ঢাকার মানুষের ওপর খুব দ্রুতই মেট্রোরেলের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অনেকই ফেলছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। রাজধানীর মানুষের যাতায়াত ভীতি কমেছে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঝামেলবিহীন টিকিট কেটে ছুটে যাচ্ছে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এ যেন স্বপ্নকে ছুঁঁয়ে দেখা। আধুনিক প্রযুক্তির এক অনন্য উদাহরণ হয়ে ঢাকার আকাশ ছুঁয়ে চলছে এক বিশাল দেহী ‘বৈদ্যুতিক রেল’। নাগরিক জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দারুণ যোগসূত্র যেন এ মেট্রোরেল। নারী যাত্রীদের জন্য একটু ভালো লাগা হচ্ছে আলাদা কামরা। শহরের কর্মজীবী নারীরা নিরাপদ ভ্রমণের সুযোগ চেয়েছিলেন, মেট্রোরেল সেই সুযোগ তৈরি করে দেয়ায় তারা বেশ তৃপ্ত। আলাদা কামরা থাকায় অনেকে মেট্রোরেলকে নারীবান্ধব পরিবহনও বলছেন।

আগারগাঁও মিউজিক কলেজের স্নাতকে অধ্যয়নরত কয়েজন ছাত্রী সকালে হাঁটতে বেরিয়েছেন, কাছেই স্টেশন থাকায় উঠে পড়েন মেট্রোরেলে। এই প্রতিবেদকের সাথে কথোপকথনের একপর্যায়ে অকপটে নিজেদের স্বস্তির কথা জানান তারা। টিউশনি, কেনাকাটা ও খণ্ডকালীন চাকরির জন্য সহজইে তারা এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পারছেন। এতে তরুণ-তরুণীদের পেশাগত গতিশীলতা বেড়েছে। শ্যামলী থাকেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইটি অফিসার প্রতীক। তিনি বলেন, খুব অল্প সময়ে উত্তরাতে অফিস করতে পারছি। তার মতো শত শত অফিসযাত্রী নিয়মিত বাহন এখন মেট্রোরেল। আগারগাঁওয়ের এসে অফিস করা উত্তরার বাসিন্দা কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, তারা এখন আর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছেন না। যানজট এড়াতে মেট্রোরেল বেছে নিয়েছেন। এতে তাদের তেল ও অন্যান্য বাড়তি খরচ কমে গেছে। এমন অনেকেই তাদের ব্যয় কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি উত্তরার নওরীন ইসলাম নামের একজন গৃহিনী সকাল ৯টার দিকে ফার্মগেট এসেছিলেন এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে। খুব কম সময়েই আত্মীয়কে দেখে উত্তরায় ফিরেছেন। তিনি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আগে এদিকে কালেভদ্রে আসা হতো, এখন হরহামেশাই ছুটে আসি। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় তার মতো অনেকেই কাজের ফাঁকে ছুটে যেতে পারছেন শহরের অন্য প্রান্তে থাকা স্বজনদের কাছে। এতে সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। উত্তরার মেট্রো-স্টেশন সংলগ্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, তাদের ব্যবসার প্রধান গ্রাহক মূলত এর নিয়মিত যাত্রীরা। নতুন কয়েকটি খাবার হোটেল ও চায়ের দোকান হয়েছে। আরো দোকান খোলার প্রস্তুতি চলছে। সেই আয়োজনও চোখে পড়ল। এমনকি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট চালু হচ্ছে। নানা রকম পসরা সাজিয়ে বসেছেন ছোট দোকানিরা। ঘুরতে আসা যাত্রীরাও আড্ডায় বসেছেন এসব দোকানে। ক’জন হোটেল ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদককে বলেন, মেট্রোরেলের কারণে এলাকাটি আরও জমে উঠবে।

মেট্রোরেলের অফিস সূত্রে জানা গেছে, চালু হওয়ার পরবর্তী ৩৩ দিনে, তিন লাখ ৩৫ হাজার যাত্রী পরিবহন করেছে এবং এই খাত থেকে দুই কোটি ৪৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। তবে এটি নির্ভর করছে সব ক’টি স্টেশন চালু হওয়ার ওপর।

উত্তরার ৩নং সেক্টরের গ্রামীণ কালেডেনিয়ান নার্সিং কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক নিরু শামসুন্নাহার আমার সংবাদকে বলেন, মেট্রোরেলের প্রভাবে তার প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ১০ শতাংশ বেড়েছে। আগামী সেশনে ছাত্রী ভর্তি আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, তারা এখন বেশ স্বস্তিতে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্টেশন সংলগ্ন কলেজটিতে আসতে পারেছেন। যাতায়াতের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকরা এখন আর আগের মতো উদ্বিগ্ন নন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য  ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আমার সংবাদকে বলেন, মেট্রোরেল রাজধানীর নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে। মানুষ ধীরে ধীরে এর সুফল পেতে শুরু করেছে। মানুষের কাজের গতিশীলতা বাড়ছে।  ঢাকার  যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। যানজটের কবল থেকে মানুষ মুক্তি পেতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক নাসরুল্লাহ মো. ইরফান আমার সংবাদকে বলেন, মেট্রোরেল সরকারের একটি যুগান্তকারী প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে ফলে ঢাকার মানুষের জীবন যাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সামগ্রিক অর্থনীতি ও জিডিপিতে এর প্রভাব পড়বে। এ উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

মেট্রোরেল এই অঞ্চলে কি পরিবর্তন এনেছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া আমার সংবাদকে বলেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ার ফলে স্টেশনের আশপাশের অঞ্চল ও  আগারগাঁও এলাকার মানুষের পেশাগত গতিশীলতা বেড়েছে। মানুষের সময় বেশি কাজে লাগছে। আগামী দিনগুলোতে এর বিস্মৃতি আরও বাড়বে।

এ বিষয়ে শিক্ষা উদ্যোক্তা ও বেসরকারি অতীশ দিপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি সদস্য সৈয়দ হেমায়েত হোসেন বলেন, যেকোনো দেশের উন্নয়নের প্রধান শর্ত হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা। এই দুটোর সাথে একটা কো-রিলেশন আছে। মেট্রোরেল চালু করার ফলে আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ, এই অঞ্চলের মানুষের কাজের গতি অনেক বেড়ে গেছে এবং সময়ের অপচয় অপেক্ষাকৃত কম হচ্ছে। তারা নিজের মতো করে সময়টাকে ব্যবহার করতে পারছে। শিক্ষার মান বাড়ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি ও সংখ্যা বাড়ছে। এ অঞ্চলের সামগ্রিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অতীশ দিপঙ্করের উপাচার্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা মেট্রোরেল নিয়ে বেশ উৎফুল্ল। তিনি এই প্রকল্পকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, যা এই এলাকার সামগ্রিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। একই প্রতিষ্ঠানের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষিকা সুরাইয়া খানম মিম জানান, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে আগারগাঁও হয়ে এখানে নিয়মিত যাতায়াত করছেন। বেশ সহজ ও আরামদায়ক যাত্রা এটি। উত্তরার কয়েকজন বাড়ির মালিক জানান, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এই এলাকার পরিবেশ বদলে যেতে শুরু করেছে। সব থেকে বড় বিষয় হলো— স্বস্তির জায়গাটা ফিরে এসেছে। এখান থেকে আগারগাঁও-মিরপুর-শ্যামলী-সংসদ ভবন সংলগ্ন এলাকায় যাতায়াতের সহজ হওয়ায় ভাড়াটিয়াদের বাসা পরিবর্তন করতে হচ্ছে না।

আগারগাঁও ষাটফিট এলাকার বাসিন্দা নারী উদ্যোক্তা নুসরাত জাহান ইলোরা বলেন, আমার মায়ের বাসা উত্তরা দিয়াবাড়িতে এবং আমার ব্যবসার নানা কাজেও  নিয়মিত উত্তরা যতে হয়। এটি এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমি সকালে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে পারি। এতে আমার সময় সাশ্রয় হচ্ছে। শ্যামলীর বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা মাহফুজ বলেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর ব্যাংকের বেশ কয়েকজন এক সাথে উত্তরা থেকে রওনা দেই। আমাদের জন্য এই রেল যোগাযোগ একটি আশীর্বাদ হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশ বেতারের একজন নারী  কর্মকর্তা বলেন, আমি উত্তরা এলাকা থেকে খুব অল্প সময়ে আগারগাঁও চলে আসতে পারি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করতে হয় না। পরিবারের সব কাজ সেরে আমার মতো শত শত নারী আগারগাঁও-শ্যামলী-মিরপুর অঞ্চলে রওনা হন। আমাকে এখন আর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে হচ্ছে না। তবে বিকেলে একটা সিডিউল দ্রুত চালু করলে  আমাদের স্বস্তিটা পূর্ণতা পেত। উত্তরা এবং আগারগাঁওয়ের পল্লবী স্টেশনের প্রায় সব যাত্রী একই কথা বলেন। তারা মেট্রোরেলের বিকেলের পর ফেরার সময়ের একটি সিডিউল চান  এবং অতি দ্রুত সব স্টেশন চালুর দাবি জানান। সবগুলো স্টেশন চালু হলে পরিপূর্ণভাবে মেট্রোরেলের সুফল ভোগ করতে পারবেন যাত্রীরা।

আগারগাঁওয়ের পরের স্টেশন কবে খুলছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড বা ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক আমার সংবাদকে জানান, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব আমরা এটি চালু করব। আমরা জনগণের স্বস্তির বিষয়টির প্রতি ভীষণ মনোযোগী। তবে এমআরটি লাইন-৬ এর মতিঝিল অংশ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে। কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করার কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। তিনি আরো বলেন, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বছরে) ক্ষতি হচ্ছে। এমআরটি নেটওয়ার্ক চালু হওয়ার পরে ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রতি বছর সাশ্রয় হবে। লাইন-৬ চালু হয়ে গেলে ‘টাইম কস্ট’ আট কোটি ৩৮ লাখ টাকা প্রতিদিন সাশ্রয় হবে। একই সাথে ‘অপারেশন কস্ট’ বাবদ সোয়া কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। উল্লেখ্য সাড়ে ছয় বছরের নির্মাণ কার্যক্রম শেষে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে মেট্রোরেল উদ্বোধন করেছেন প্রধাানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। ২০২৪ সালের জুন মাসে এমআরটি-৬ লাইন চালু হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই প্রথম অংশ উদ্বোধন করা সক্ষম হয়েছে।