আশ্বাসের ফল নেই

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৩, ১১:৪৮ পিএম
  • রোজার আগেই বাড়ছে পণ্যের দাম

 

রমজান উপলক্ষে পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে

—বাংলাদেশ ব্যাংক

 

পেঁয়াজের প্রয়োজনীয় এলসি খুলছে না ব্যাংক

—ব্যবসায়ীদের অভিযোগ

 

আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে পণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশ্বস্ত করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশ ব্যাংকও জানিয়েছে প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে, তাই রমজান উপলক্ষে কোনো পণ্যের সংকট হবে না। কিন্তু বাজারের চিত্র ভিন্ন। এরই মধ্যে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের মধ্যে পেঁয়াজ ও ছোলার দাম বাড়ছে। সপ্তাহ ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম দু-তিন টাকা আর এক মাসের ব্যবধানে ছোলার দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংকট না থাকলেও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে দাম।

গত ২২ জানুয়ারি রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের উদ্যোগে আয়োজিত মাসব্যাপী রংপুর শিল্প ও বাণিজ্য মেলা-২০২৩ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, রমজানে কোনো পণ্যের সংকট হবে না, মূল্যও বৃদ্ধি পাবে না। ভোক্তারা যদি একসঙ্গে বেশি পণ্য ক্রয় না করেন, তবে বাজারে পণ্যের ওপর বেশি চাপ পড়বে না। তিনি বলেন, পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বা স্বাভাবিক সময়ে যদি কোনো ব্যবসায়ী অবৈধ মজুত ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে

 কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকার ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের সহযোগিতা করছে।  অন্যদিকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, আসন্ন রমজান মাসকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে, যার পরিমাণ গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় অনেক বেশি। চিনি, ছোলা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও খেজুর— এই পাঁচ পণ্যের চাহিদা রমজান মাসে বাড়ে। সেটিকে মাথায় রেখে পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে। পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে রমজানে কোনো পণ্যের ঘাটতি হবে না। 

তবে রমজানের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্তোষ প্রকাশ করলেও আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। রমজানের পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুই বার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। এর প্রেক্ষিতে ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর, ভোজ্যতেল, চিনিসহ আটটি পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংক, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও অসাধু ব্যবসায়ীদের অপকর্মে অস্থিতিশীল হতে শুরু করেছে বাজার। এতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে সাধারণ মানুষের।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সারা বছরের নিত্যপণ্য আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশই রমজানের পণ্য আমদানিতে খরচ হয়। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে। এজন্য পরিস্থিতি সামলাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রমজানের পণ্য আমদানির চাহিদা মেটাতে আলাদাভাবে ডলার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছে। এর মধ্যে রমজানের চাহিদার প্রায় সমপরিমাণ এলসি ইতোমধ্যে খোলা হয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা শুরু হয়। 

গতকাল শনিবার রাজধানীর মৌলভীবাজার, শ্যামবাজার, রায়সাহেব বাজার, সুত্রাপুর, ধূপখোলা মাঠ বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি। আর মুড়িকাটা দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি মানভেদে ২৬ থেকে ২৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হতো ২৫ থেকে ২৮ টাকা কেজি। আর আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ছিল ২৬ থেকে ২৮ টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজিতে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা। এ বছর তানজানিয়া থেকে আসা ছোলা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকায়, যা গেল বছর ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা ভালো মানের ছোলা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৬ টাকায়, যা গেল বছর বিক্রি হয়েছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা।   খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা আর মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা। 

আর আমদানিকৃত ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা কেজি দরে। বর্তমানে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আসছে না। এদিকে ছোলা ভালো মানের (অস্ট্রেলিয়া) প্রতি কেজি খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯২ টাকা। আর তানজানিয়ার ছোলা খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৭ টাকা। এক মাস আগে প্রতি কেজি ছোলার দাম মান ভেদে ৮০ থেকে ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি কেজি ছোলার দাম কেজিতে পাঁচ টাকা করে বেড়েছে। বিভিন্ন ট্রেডিং ও পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে পাইকারিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি হওয়া ছোলা প্রতি মণ তিন হাজার ১০০ থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকায় লেনদেন হতে দেখা গেছে। এছাড়া তানজানিয়ার ছোলা বিক্রি হচ্ছে মণ প্রতি তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায়। এক মাস আগেও যা দুই হাজার ৬০০ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে লেনদেন হয়েছিল।

পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যাংকগুলো পেঁয়াজের এলসি দিচ্ছে। ফলে বাড়তি চাহিদার জন্য এলসি খোলার পাশাপাশি আমদানিকারকরা বন্দর দিয়ে পেঁয়াজের আমদানি বাড়িয়েছিলেন। তবে এখনো বাজারে দেশি পেঁয়াজের ভালো সরবরাহ থাকায় আমদানিকৃত পেঁয়াজের চাহিদা কিছুটা কম। এতে চাহিদার তুলনায় আমদানি বাড়ায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতির দিকে ছিল। পক্ষান্তরে ভারতের বাজারেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এ অবস্থায় তা আমদানি করে লোকসান গুনতে হচ্ছিল আমদানিকারকদের। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমায় আমদানিকৃত ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়ছে। সেই সঙ্গে দেশি পেঁয়াজের দামও খানিকটা বাড়ছে।

এদিকে দেশে সীমিত পরিসরে ছোলা উৎপাদন হলেও চাহিদার বেশিরভাগই আসে অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, তানজানিয়া থেকে। আগে মিয়ানমার থেকে আমদানি হলেও চলতি মৌসুমে এখনো প্রতিবেশী দেশটির ছোলা আসেনি। চলতি বছর চাহিদার তুলনায় আমদানি কম হওয়ায় রোজায় পণ্যটির দাম বেশি হবে বলেই ধরে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে আগে থেকেই মজুতের পাশাপাশি বিক্রির ক্ষেত্রে বাড়তি দাম হাঁকিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ানো হয়েছে কৌশলে। তাই এক মাসের ব্যবধানে ছোলার দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ।

পুরান ঢাকার মৌলভিবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে এক বছরে যে পরিমাণ ছোলা বিক্রি হয় তার অর্ধেকই হয় কেবল রমজান মাসে। এ কারণে বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে আমদানিকারক ও মজুতদার ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও বড় ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেয়া দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে ছোলার দাম বাড়ানো হয়। দেশে মুষ্টিমেয় কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছোলা আমদানির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সহজেই পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, রোজার এক সপ্তাহ আগে ও রোজার সময় সরকারি পর্যায়ে বাজার মনিটরিং কমিটির অভিযান থাকায় কৌশলে কয়েক মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। মূলত বর্তমানে দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা তুলে নেয়ার পর বাজার মনিটরিং কমিটির অভিযানকালীন সমন্বয় করে কমানোর কৌশল নিয়েছে আমদানিকারক ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা। তাই দেশের পণ্যমূল্যের দাম স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি রোজায় অস্বাভাবিক মুনাফা রোধ করতে কয়েক মাস আগে থেকেই বাজার মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি বলে মনে করছেন এ ব্যবসায়ীরা। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, রমজানে সাধারণত নিত্যপণ্যের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় দুই থেকে আড়াইগুণ বেড়ে যায়। একটা অসাধু ব্যবসায়ী চক্র এই সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে পণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এ জন্য বাজার ঠিকমতো মনিটরিং করা দরকার।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে এবার রোজায় আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়বে। সরকারের আরেক সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রোজার দেড় মাস আগেই গত বছরের তুলনায় আমদানি করা পণ্যের দাম গড়ে ৫৯ শতাংশ বেড়েছে।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য মতে, গত ২০ থেকে ২৫ দিনে মানভেদে ছোলা মণপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। বিদেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি ২২ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৮ টাকার মধ্যে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ছোলার বার্ষিক চাহিদা প্রায় দেড় লাখ টন, রোজার চাহিদা ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন। পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন; এর মধ্যে রোজার চাহিদা পাঁচ লাখ টন। এ বছর দুই লাখ ২৪ হাজার ৫৬৭ টন ছোলা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৬ টন। ৪২ হাজার ৫৬৩ টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খুললেও গত বছরের একই সময় ছিল ৩৬ হাজার ২২৬ টন।