সাগরে তেল-গ্যাস উত্তোলন

চলতি বছরই উৎপাদন শুরু

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৩, ১২:১৫ পিএম
  • অগভীর সমুদ্রে ১১টি গভীর সমুদ্রে ১৫টি ব্লক তৈরি, বাপেক্স ও আইওসির যৌথ উদ্যোগ

বিদেশি কোম্পানিগুলো কাজ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে —ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা
আমরা চলতি বছর সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করব —জনেন্দ্র নাথ সরকার, চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলা
গত এক দশক সাগরে অনুসন্ধান না করা সরকারের বড় ধরনের ভুল ছিল —বদরূল ইমাম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ

সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অনুসন্ধান কাজে অংশ হিসেবে প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে চলতি বছরই সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করতে চায় পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০২০ সালে আগ্রহী কয়েকটি কোম্পানির সাথে মতবিনিময় সভা করা হয়েছিল।

সভায় কনোকো ফিলিপস, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, এক্সম মোবিলের মতো কোম্পানি অংশ নিয়েছিল। সে সময় তাদের কাছে যে পিএসসি উপস্থাপন করা হয়েছিল সেটি পিএসসি ২০১৯-এর সংশোধন করা। এ বিষয়ে সেই সময় কোম্পানিগুলো এই পিএসসি আরও সংশোধন করে আকর্ষণীয় করার পরামর্শ দেয়। কয়েক দফা সংশোধনের পর পিএসসি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। পেট্রোবাংলা দরপত্র আহ্বানের অন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) নতুন করে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তড়িৎ উৎপাদনের জন্য ২০২২-২৫ চার বছর মেয়াদি কূপ খননের কার্যমেয়াদ এক বছর কমিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যে এই ৪৬টি কূপ খননে কাজ সম্পন্ন হবে। আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এ জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এতে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাসের সংস্থান হবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স) ও আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির (আইওসি) যৌথ উদ্যোগে পার্বত্য অঞ্চলে ১০টি স্থানে গ্যাস-খনিজ অনুসন্ধানে কাজ করবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, দেশের স্থল ও সাগরে তেল-গ্যাস উত্তোলনে আমরা আগে থেকে তাগিদ দিয়ে আসছি। আর এতে বিপুল খনিজসম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা বলছেন, দেশে উত্তোলন বাড়তে পারলে উচ্চমূল্যের এলএনজি কেনার প্রয়োজন পড়বে না। এতে  আমাদানি-নির্ভর আমাদের জ্বালানি খাত স্বনির্ভর হবে।

সূত্র বলছে, দেশের স্থলভাগকে ২২টি এবং সমুদ্রভাগকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এই ২৬টির মধ্যে ১১টি ব্লক অগভীর সমুদ্রে অবস্থিত। বাকি ১৫টি গভীর সমুদ্রে। এখন পর্যন্ত শুধু অগভীর অংশের দুটি ব্লকে (এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯) অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড। চলতি বছরে তাদের জরিপ কাজের ফলাফল পাওয়ার কথা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সমপ্রতি গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকের সবগুলোতে অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে জ্বালানি খাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি এক্সন মোবিল।

এক্সনের কাজ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ-বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, এক্সনের প্রস্তাবের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তবে আগে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানের জন্য কয়েক বার দরপত্র আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে খুব একটা আগ্রহ দেখতে পাইনি। কনকো ফিলিপস এসে চলে যায়। পসকো দাইয়ুও এসে চলে যায়। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক্সন মোবিল খুব আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করছে। আমাদের আলোচনা চলছে। তারা রাজি হলে আগামীতে একটি চুক্তি সই করা হবে।

জ্বালানি উপদেষ্টা আরও বলেন, এক্সন মোবিল কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকে। আমার ধারণা, তারা তাদের জ্বালানির উৎসে বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে হবে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্য কিছু স্থানেও উৎস তৈরি করতে চায়। যেন কোনো কারণে বিদ্যমান উৎস থেকে গ্যাস পেতে বাধা তৈরি হলে সরবরাহে সমস্যা তৈরি না হয়। ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে এক্সন মোবিল বাংলাদেশে আগ্রহী হতে পারে। আমি প্রায় পাঁচ বছর ধরে তাদের সঙ্গে আলাপ করছি। তাদের বলেছি, দেশের লাভ থাকলে তাদের সঙ্গে চুক্তি সই করব আমরা। এই বছরের মধ্যে চুক্তিটি চূড়ান্ত করার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। চুক্তির পর কাজ শুরু হলে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস পৌঁছে দিতে ১০ বছর লাগবে।

এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমরা চলতি বছর সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করতে চাই। এ জন্য পিএসসি সংশোধন করে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। আগামী ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টির ডিপিপি সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর ডিপিপিও আগামী দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। এই দুই বছরে বাপেক্সের চারটি রিগ এবং লোকবল পূর্ণ সক্ষমতায় ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ২৮টি কূপ খনন করা যাবে। বাকি ১৮টি কূপ বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বা বাপেক্স ও বিদেশি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে খনন হতে পারে।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জিকে দিয়ে ইতোমধ্যে পিএসসির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা নিজস্ব মতামতসহ এটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় গত ফেব্রুয়ারিতে। আগেরটি থেকে এটিতে উৎপাদন ও দাম আরও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এতে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর এটি অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিপরিষদ কমিটি বিশ্লেষণ করবে। এই অনুমোদনের পর চূড়ান্ত পিএসসি ঘোষণা করা হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করে বাংলাদেশ। এই ১০ বছর সাগরে অনুসন্ধান না করা বড় রকমের ভুল।

এটি পেট্রোবাংলার দুর্বলতা। দেশে ভূখণ্ডে অনুসন্ধান কূপ খননের হার খুব কম। বছরে গড়ে একটি। এটি খুবই কম। এখন দুই বছরে ১৫টি অনুসন্ধান কূপ খননের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এটি অনেক দেরিতে নেয়া হলো। এর আগেও ১০৮টি কূপ খননের প্রকল্প নিয়ে বাতিল করা হয়েছিল। এবার যেন তেমন না হয়। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এতে আমাদের সর্বমোট এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা নিরঙ্কুশ হয়। কিন্তু এখনো সেই অর্থে সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হয়নি।