দেশে টানা বর্ষণ ও ভারতের সিকিম রাজ্যের তিস্তার ব্যারাজ খুলে দেয়ায় বন্যার শঙ্কায় পড়েছে দেশ। ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। টানা বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবন। দেশের অনেক অঞ্চলেই শহরগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে জনদুর্ভোগ, ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিভিন্ন স্থানে রেল ও সড়কপথ বন্ধ রয়েছে। ব্যবসা নেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। সমুদ্র বন্দরে তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখানো হয়েছে। সেন্টমার্টিনে আটকা পড়েছেন দুই শতাধিক পর্যটক। বৃষ্টি কমার ব্যাপারে আগামী এক সপ্তাহ কোনো সুখবর দেখছেন না আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাত ৩০০ মিলিমিটার ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে ১৯৭১ সালের পর এবারই প্রথম ময়মনসিংহে ৩৭৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নেত্রকোনায় ৩৫১ ও কিশোরগঞ্জের নিকলীতে ৩১১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায়ও বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় ঢাকায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে— খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফরিদপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া ও সিলেট অঞ্চলের ওপর দিয়ে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে বজ্রমেঘ সৃষ্টি অব্যাহত থাকায় শুক্রবারও চট্টগ্রাম, পায়রা, মোংলা ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত বহাল রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর।
জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত জনজীবন ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা : পুরো এক রাতের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ময়মনসিংহ নগরীর রাস্তাঘাট। পানি উঠেছে বাসাবাড়ি ও দোকানে। বাসায় পানি ওঠায় অনেকের রাত কেটেছে নির্ঘুম। নগরী ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় বাসার হাঁটু পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন পলি (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ। ফরিদপুরের ভাঙ্গা, আলফাডাঙ্গা ও সালথা উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে কয়েকটি গ্রামের শতাধিক কাঁচা-পাকা বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে তিন শতাধিক গাছপালা ও বেশ কয়েকটি বিদ্যুতের খুঁটি। এ ছাড়া ভাঙ্গায় ঘরের ওপর গাছ পড়ে ঝর্ণা বেগম (২১) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার বাইপাইলের কাঁচাবাজার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে বাইপাইলের আড়ত ও কাঁচাবাজার। এ জন্য কিছু দোকান খুললেও ক্রেতা দেখা যায়নি। এ অবস্থার জন্য দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন তারা। বগুড়ার শেরপুরে বিগত চার দিনের প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঙালি ও করতোয়া নদীর পানির অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এমনকি পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পৌরশহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডসহ উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অনেক বাসা-বাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে দুই হাজার পরিবার।
সমুদ্র বন্দরে তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত, সেন্টমার্টিনে আটকা দুই শতাধিক পর্যটক : কক্সবাজারে বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল ও ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত থাকার কারণে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে ট্রলার ও জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে তিন দিনেও সেন্ট মার্টিনে আটকেপড়া দুই শতাধিক পর্যটক টেকনাফে ফিরতে পারেননি। গত ৩ অক্টোবর সকাল থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে সেন্ট মার্টিনে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন হোটেল ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কানিকাটা বিল এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার রেললাইন পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ৩৭ আপ একটি মেইল ট্রেন কানিকাটায় আটকে আছে। অপর দিক থেকে ৩৭ ডাউন মেইল ট্রেনটি ময়মনসিংহের নান্দাইল স্টেশনে আটকে আছে।
তিস্তার ৪৪টি ব্যারাজ খোলা : এদিকে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে রাখা হয়েছে। রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ভারতের উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে বাংলাদেশের তিস্তা বেষ্টিত উত্তরাঞ্চলেও বন্যার শঙ্কা করা হচ্ছে। নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে কাজ করছে স্থানীয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সকালে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক ৪৭ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার)। অন্যদিকে সকাল ৯টার তথ্যনুযায়ী রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে পানি সমতল থেকে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার (স্বাভাবিক ২৮ মিটার ৭৫ সেন্টিমিটার) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ এলাকার তিস্তা নদীর চর থেকে অজ্ঞাত দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে থানা পুলিশ। এ পর্যন্ত ভারতের বন্যার পানিতে ভেসে আসা চারজনের মরদেহ তিস্তা থেকে উদ্ধার হয়েছে।
তলিয়ে গেছে জমির ধান ও শীতকালীন সবজি ক্ষেত : তিস্তার পানিপ্রবাহ বিপদসীমার নিচে নেমে আসায় বন্যা পরিস্থিতিরও কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। কমতে শুরু করেছে নিম্নাঞ্চলের পানি। এতে তারা শঙ্কামুক্ত হতে শুরু করেছেন। তবে বন্যার পানিতে চরের কোথাও কোথাও শত শত হেক্টর জমির ধান ও শীতকালীন সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে নদীভাঙন।
বিভিন্ন স্থানে বন্ধ সড়ক ও রেল যোগাযোগ : দেশের ব্যস্ততম সড়ক টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের আশুলিয়ার বেশ কিছু অংশে ঢেউ খেলছে বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি। গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা বৃষ্টিতে সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাইপাইল-জামগড়া এখন হাঁটুপানির নিচে। সড়ক ব্যবহারকারীদের ভোগান্তি এখন চরমে। সরেজমিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঢাকার টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের আশুলিয়ার বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, চারিদিক বৃষ্টির পানি থইথই করছে। বাইপাইল স্ট্যান্ড থেকে জামগড়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কের এ অবস্থা। বৃষ্টির পানিতে কিশোরগঞ্জে প্রায় এক কিলোমিটার রেললাইন পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। গতকাল সকাল ১০টা থেকে আটকে পড়েছে দুই পাশের দুটি মেইল ট্রেন।
গতকাল দুপুরে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার মো. মিজানুর রহমান এ কথা জানিয়েছেন। পরবর্তী এক সপ্তাহ আবহাওয়ার অবস্থা জানিয়ে আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, শনিবারে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায়; বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের দু’-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
আগামী রোববার সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায়; ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের দু’-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে। রোববার সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। পরবর্তী পাঁচ দিনের পরবর্তী পাঁচ দিনের এ সময়ের শেষ দিকে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে।