দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান

ফুরফুরে মেজাজে আ.লীগ

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৩, ১১:৫৪ পিএম
  • বিদেশিদের তৎপরতায় ফলাফলের নজির নেই
  • সব বড় পরিবর্তন এসেছে জনতার আন্দোলনে

যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানসহ নানা কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেও দেশটি প্রভাবশালীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এসব নানা কারণে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময় এলে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো সতর্ক দৃষ্টি রাখে। শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশ প্রকাশ্যে ও গোপনে তৎপরতা চালায়, কূটনৈতিক সীমা লঙ্ঘন করে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করে। নির্বাচন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হওয়ার পরও কেন বিদেশিরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নাক গলায়— এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। যারা যখন বিরোধী দলে থাকে তারা সরকার হটানোর আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশিদের সহযোগিতা চায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেখানে বিদেশিদের তৎপরতা খুব বেশি কাজে এসেছে— এমন নজির দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, বিদেশিরাও কূটনৈতিক ভাষায় বলেন— তারা জনগণের সঙ্গে রয়েছেন, জনগণের মতামতই তাদের মত। ঠিক বাস্তবতাও হচ্ছে— দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় সব পরিবর্তনই হয়েছে জনগণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে। 

গত শুক্রবার ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেন। ওই চার মন্ত্রীর বৈঠকের পর ভারতের বিদেশ সচিব ভিনয় কোয়াত্রা বলেছেন, ওই বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা  হলেও দুটি দেশের কোনো দেশের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। তবে ভিনয় কোয়াত্রা তার দেশের যে অবস্থানের কথা জানিয়েছেন তা হচ্ছে— ‘বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। বাংলাদেশের নির্বাচন সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সে দেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’ 

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকায় গোলাপবাগে শোডাউন করার পর বিদেশিরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী অনেক দেশ প্রকাশ্যে তৎপরতা চালালেও নিকটতম প্রতিবেশী এবং ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিবেচিত ভারত কোনো তৎপরতা চালায়নি। অন্যান্য নির্বাচনের সময় ভারত প্রকাশ্যে নির্বাচন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করলেও এবার কিন্তু একেবারেই নিশ্চুপ ছিল। এ কারণে অনেকেই বলাবলি করছিলেন, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ভারত হয়তো দূরে সরে গেছে। কেউ কেউ এটিও বলছিলেন, এবার ভারত চাচ্ছে দেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটুক, তারা নির্বাচনে একেবারেই নিশ্চুপ থাকবে। 

কিন্তু গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় ভারত বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে যে অপছন্দ করে তা ডিপ্লোম্যাটিক ভাষায় বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আর ‘নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়’ ভারতের এমন মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গেছে— বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন তৎপরতা ভারত কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখছে না। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ থাকার পর ভারত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মুখ খোলায় ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে অনেকটা স্বস্তি ফিরেছে। দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ফুরফুরে মেজাজ তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও অনেকটা ভরসা পাচ্ছেন। নির্বাচনে বাইরের কোনো দেশ বা দেশের কর্মকর্তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ না থাকলেও তাদের অবস্থান যদি কোনো বিশেষ দলের পক্ষে যায় তাহলে সেই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙাভাব তৈরি হবে— এটিই স্বাভাবিক। এর আগে বিএনপির মহাসচিব প্রকাশ্যে জনসভায় বলেছেন, তিনি পশ্চিমাদের তৎপরতায় উৎসাহ পাচ্ছেন। অর্থাৎ দেশের রাজনীতিতে এমন বাস্তবতা এখন বিদ্যমান।  দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা যখন নাক গলায় তখন জনগণ অপমানিত বোধ করে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। 

দৈনিক আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাকালে তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অতীতে বড় ধরনের যেসব পরিবর্তন হয়েছে তা জনগণই করেছে, জনগণের আন্দোলনেই ১৯৭১, ১৯৯১-সহ বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে। এখনো কোনো পরিবর্তন চাইলে সেটি অবশ্যই জনগণের আন্দোলনেই হতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিরা যখন প্রকাশ্যে তৎপরতা চালায় তখন একদিকে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়, অন্যদিকে এটি আমাদের স্বাধীন সত্তার জন্য লজ্জাজনক।’ 

তিনি অবশ্য এও বলেন, ‘বিদেশিরা যে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালায় এটি প্রকৃতপক্ষে তাদের দোষ খুব একটা বেশি দেয়া যাবে না। কারণ আমরাই তাদের কাছে যাই। শুধু যে রাজনীতিকরা যান তা কিন্তু নয়, অনেক ক্ষেত্রে সিভিল সোসাইটির লোকজনও বিদেশিদের কাছে যান।’ এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক।