আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের জামানত দখলে নিয়েছে হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স
ঋণের জামানত হিসেবে ব্যাংকে বন্ধক থাকা শেয়ার জালিয়াতির মাধ্যমে ওই শেয়ারের বিপরীতে পাঁচজন পরিচালক নিয়োগ দেয়ার মতো তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এমনকি কোম্পানিটির ভাষ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের নামে থাকা ১০ হাজার শেয়ারের বিপরীতে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে কোনো লভ্যাংশ দেয়া হয়নি। বার্ষিক সাধারণ সভা- এজিএমেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি ব্যাংককে। প্রকৃত শেয়ার সার্টিফিকেটসহ উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপনের পরও ব্যাংকের ৭০ লাখ টাকা মূল্যের ৭০ হাজার শেয়ার জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে বিমা কোম্পানিটি। মৃত ব্যক্তির দ্বারা শেয়ার সার্টিফিকেট চুরির মতো হাস্যকর অভিযোগ তুলে নিজেদের ফাঁদেই আটকা পড়েছে হোমল্যান্ড।
সম্প্রতি লভ্যাংশ চেয়ে পাঠানো ব্যাংকের চিঠির জবাবে হোমল্যান্ড জানিয়েছে, ব্যাংকের কাছে থাকা শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো তাদের অফিস থেকে বেআইনিভাবে হস্তগত করেছিল হোমল্যান্ডের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ। অপরদিকে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের কাছে থাকা নথিপত্র অনুযায়ী, ২০০৫ সালে জামানত হিসেবে রাখা শেয়ারগুলো ২০০১ সালেই ব্যাংকটির গ্রাহকের নামে হস্তান্তর হয়েছে। আর জামানতকারী মারা গেছেন ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। হোমল্যান্ডের ভুয়া পরিচালকরা শেয়ার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে মর্মে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ২০১৬ সালে। বিজ্ঞপ্তি ও থানায় জিডির তথ্য অনুযায়ী শেয়ার হারিয়েছে ২০১৪ সালে। এদিকে গত ৮ নভেম্বর ব্যাংকের উদ্দেশে পাঠানো চিঠিতে হোমল্যান্ড দাবি করেছে শেয়ারগুলো তাদের অফিস থেকে চুরি হয়েছে। অর্থাৎ ২০০৫ সালে মারা যাওয়া ব্যক্তি ২০১৪ সালে শেয়ার সার্টিফিকেট চুরি করেছেন। অথচ ২০০৫ সাল থেকেই শেয়ারগুলো ব্যাংকের লকারে জামানত হিসেবে রয়েছে। তবে ব্যাংকের জামানতের ৮০ হাজার শেয়ারের মধ্যে ১০ হাজার শেয়ারের কথা স্বীকার করছে হোমল্যান্ড। কিন্তু ১৭ বছর ধরে লভ্যাংশ না দেয়া এবং এজিএমে আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি কোম্পানিটি।
আমার সংবাদের হাতে থাকা নথিপত্র ও ব্যাংক ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ নামে একজন গ্রাহককে ২০০৫ সালে ৮০ লাখ টাকা ঋণ দেয় আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের (তৎকালীন নাম দি ওরিয়েন্টাল ব্যাংক) সিলেট শাখা। ১৫ শতাংশ মুনাফায় বিনিয়োগকৃত ওই ঋণের জামানত বাবদ প্রয়োজনীয় পরিমাণে স্থাবর সম্পত্তির পাশাপাশি হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ৮০ হাজার শেয়ার জমা রাখে ব্যাংক। প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের ওই শেয়ারের দাম ছিল ৮০ লাখ টাকা। ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক মারা যান। এর ছয়দিন পর ২৮ ফেব্রুয়ারি হোমল্যান্ডকে চিঠি দিয়ে জামানতে থাকা ৮০ হাজার শেয়ারের কথা জানায় ব্যাংক। পাঁচ মাস পর চিঠির জবাব দেয় হোমল্যান্ড। ২০০৫ সালের ৪ জুলাই ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে হোমল্যান্ড জানায় ব্যাংকের গ্রাহক কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের নামে মাত্র ১০ হাজার শেয়ার রয়েছে। তিনদিন পর ফের চিঠি দেয় ব্যাংক। এতে জানানো হয়, কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের নিজের নামের ১০ হাজার শেয়ার ছাড়াও অন্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে হস্তান্তর হওয়া আরও ৭০ হাজার অরিজিনাল শেয়ার সার্টিফিকেট ব্যাংকের কাছে জামানত রয়েছে। যার উপযুক্ত প্রমাণও পেশ করে ব্যাংক। তখন ব্যাংকের চিঠির কোনো জবাব দেয়নি হোমল্যান্ড। অদৃশ্য কারণে বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকও চুপ থাকে।
আট বছর যাবত কোনো লভ্যাংশ বা এজিএমে আমন্ত্রণ না পেয়েও ব্যাংকের তৎপরতা না থাকার সুযোগ নিয়ে ২০১৪ সালে জালিয়াতির মাধ্যমে ৭০ হাজার শেয়ার হস্তগত করে ছয়জন ব্যক্তি। এদের মধ্যে পাঁচজনকে পরিচালক নিয়োগ করে হোমল্যান্ড। ব্যাংকের দাবি সত্ত্বেও শেয়ার হারিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও থানায় জিডির প্রেক্ষিতে ডুপ্লিকেট শেয়ার ইস্যু করা হয়। হোমল্যান্ডের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে ব্যাংকের শেয়ার হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে দাবি ব্যাংক কর্মকর্তাদের। প্রকৃত শেয়ার সার্টিফিকেট সংরক্ষিত থাকায় বিষয়টি নিয়ে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র সহায়তা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ব্যাংকের রিকভারি অ্যান্ড মনিটরিং ডিভিশনের প্রধান ক্যাপ্টেন (অব.) শাখাওয়াত হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ৮০ হাজার শেয়ারের অরিজিনাল সার্টিফিকেট রয়েছে। হোমল্যান্ডকে আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। কিন্তু তখন তারা চিঠির জবাব দেয়নি। এখন ডিভিডেন্ড চেয়ে চিঠি দেয়ার পর বলছে, কেবল ১০ হাজার শেয়ার রয়েছে। আমাদের ডিভিডেন্ড ও এজিএমে আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। বিষয়টি তদন্তের জন্য আমরা আইডিআরএ’র সহায়তা চাইব।’
হোমল্যান্ড সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সে বর্তমানে ১৯ জন পরিচালক। এর মধ্যে ৯ জন লন্ডন প্রবাসী। এদের মধ্যে পাঁচজন ব্যাংকের জামানত রাখা শেয়ার দখল করে পরিচালক হয়েছেন। কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ মারা যাওয়ার পরপরই তারা পরিচালক হয়েছেন। কিন্তু জাল শেয়ার সার্টিফিকেট ধরা পরার ভয়ে ২০১৬ সালে নতুন ফন্দি করেন তারা। কারণ ওই বছর ব্যাংকের পক্ষ থেকে শেয়ারগুলো বিক্রি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। অর্ধেক মূল্যে নিজস্ব লোক দিয়ে শেয়ারগুলো কেনারও চেষ্টা করে চক্রটি। ব্যাংক কম দামে শেয়ার বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ডুপ্লিকেট শেয়ার ইস্যু করা হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুই পরিচালক আব্দুল হাই ও আব্দুল আহাদ দুই ভাই থানায় জিডি করেন। তাদের শেয়ার সার্টিফিকেট রহস্যজনকভাবে একই দিনে হারিয়ে যায়। দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ ঘটনার দেড় বছর পর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তারা জিডি করেন। হোমল্যান্ড লাইফের লন্ডন প্রবাসী অপর দুই পরিচালক জামাল মিয়া ও কামাল মিয়া। তাদের কোম্পানির মালিকানার শেয়ারগুলোও একই দিন হারিয়ে যায়। ২০১৪ সালের ১০ মে তাদের শেয়ার হারালেও সিলেটের বালাগঞ্জ থানায় তারা জিডি করেন ঘটনার ১৫ দিন পর। প্রবাসী আরেক পরিচালক জামাল উদ্দিনেরও ১০ হাজার শেয়ার সার্টিফিকেট হারিয়ে যায় ২০১৪ সালের মে মাসে। এর দুই বছর পর ২০১৬ সালের ১২ মে একই দিনে একই পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি দেন ওই পাঁচ প্রবাসী পরিচালক।
এমন অভিনব জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া শেয়ারের মাধ্যমে তারা কোম্পানিটির পরিচালক হয়ে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছেন। বিগত ১৭ বছরে কোম্পানি থেকে বাগিয়ে নিয়েছেন লভ্যাংশ, বোর্ড মিটিং ফি, ঢাকা-লন্ডন আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়াসহ কোটি কোটি টাকা। যা প্রকৃত অর্থে ব্যাংকের প্রাপ্য ছিল।
শেয়ারের মুনাফা ও মালিকানা প্রশ্নে দীর্ঘদিন ব্যাংকের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক বিন আব্দুল্লাহ রিকভারি প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। রিকভারি অ্যান্ড মনিটরিং ডিভিশনের প্রধান ক্যাপ্টেন (অব.) শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা নিষ্ক্রিয় ছিলাম না। আমরা মূলত স্থাবর সম্পত্তির দিকে বেশি মনোযোগী ছিলাম। কারণ আদালতের রায় আমাদের পক্ষে আছে। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের মামলার কারণে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে পারছি না। এছাড়া শেয়ারগুলো মামলার অধীনে থাকায় এতদিন বিক্রি করতে পারিনি। ২০১৬ সালে শেয়ারগুলোকে স্থাবর সম্পত্তি থেকে পৃথক করে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় বিক্রি করতে পারিনি। যেহেতু আমাদের কাছে অরিজিনাল শেয়ার সার্টিফিকেট আছে তাই আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হবে হোমল্যান্ড। আমরা আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।’
ঋণের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শেয়ারের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল ব্যাংক। ২০১৩ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। ব্যাংকের পক্ষে রায় আসে ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর থেকে জমির ওপর মামলা করে তৃতীয় পক্ষ। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মামলা করেন সিলেটের বিখ্যাত শিল্পী হাছন রাজার নাতনি ফাতেমা নাজনীন রাজা এবং সিলেটের ডিসি। কারণ এই জমিতে হাছন রাজার মিউজিয়াম এবং ‘ডিজেবল’ স্কুল রয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, হাছন রাজার প্রকৃত মিউজিয়াম সুনামগঞ্জে আর ডিসি অফিসের স্কুলের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। তাই ব্যাংক মালিকানা ছাড়বে না। আদালতের রায় নিয়ে শিগগিরই জমি বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হবে।
শেয়ার জালিয়াতির বিষয়ে হোমল্যান্ড লাইফের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুল আলমের সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি কোম্পানি সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আলী মিয়ার আমন্ত্রণে গত ১৯ নভেম্বর কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে গেলে তিনি বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরবর্তীতে লিখিত প্রশ্নেরও উত্তর দেননি।
হোমল্যান্ডের অভিযুক্ত পাঁচ পরিচালক বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করায় তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিযুক্তদের বক্তব্য নিতে এই প্রতিবেদককে সহায়তা করেননি। এতে শেয়ার জালিয়াতিতে হোমল্যান্ডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
এ বিষয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাংক অভিযোগ করলে আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।’
ঋণের বিবরণী : ১৫ শতাংশ মুনাফায় বিনিয়োগকৃত ৮০ লাখ টাকা ঋণের বর্তমান দায় তিন কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে জামানত হিসেবে ব্যাংকের কাছে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৮০ হাজার শেয়ার এবং সিলেটে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। যার বাজার মূল্য ব্যাংকের বর্তমান পাওনা সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।