দেশে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২৩, ১১:২৭ এএম
  • বিশ্বে ভূমিকম্পে অধিক ঝুঁকিতে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয় 
  • গতকাল ৫.৬ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প অনুভূত 
  • ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় মাত্রার পূর্ব লক্ষণ 
  • সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অঞ্চলে ৮.২-৯ মাত্রার শক্তি জমা আছে
  • ঢাকার ২৫ ভাগ ভবন ভূমিকম্প সহনশীল নয়
  • ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে দুই শতাধিক গার্মেন্টকর্মী ও ঢাবির ছাত্র আহত, কুবির পাঁচ হলে ফাটল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে যে পরিমাণ 

শক্তি জমা হচ্ছে তা যেকোনো সময় প্রকাশিত হতে পারে 
—সৈয়দ হুমায়ুন আখতার, বাউবি উপাচার্য ও ভূতত্ত্ববিদ

 

রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে 
—ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ, বুয়েট

দেশে যেকোনো সময় হতে পারে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প। গবেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে খুব বেশি ক্ষতির শিকার হবে রাজধানীবাসী। এতে করে তুরস্কে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের মতো রাজধানীর ৮০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারবেটরির এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের সমতট অঞ্চলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমা হয়ে আছে। যার ফলে যেকোনো সময় বড় ধরনের কম্পন তৈরি হতে পারে। গবেষণা সংস্থাটি আরও জানায়, ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় মাত্রার একটি পূর্ব লক্ষণ। আর এতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি গবেষণায়ও একই কথা উঠে এসেছে। গবেষণা সূত্রটি জানিয়েছে, ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর থেকে বুঝা যাচ্ছে, যেকোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প একশ থেকে দেড়শ বছর পরপর হয়ে থাকে। সে হিসাবে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে যেকোনো সময় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা শহরের ২৫ ভাগ ভবন ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি হয়নি। কংক্রিটের মান তিন হাজার পিএসআই থাকা উচিত হলেও আছে এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার পিএসআই। রডের গুণগত মান থাকা উচিত ৭০ থেকে ৮০ পিএসআই। অথচ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ৪০ পিএসআই। ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে কলামে ঘন ঘন রড দিতে হয়। এগুলো না মানলে ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে ৫.৬ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫.৬। এর উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা থেকে আট কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর-পূর্বে। বাংলাদেশ ক্রমশ ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল ভূমিকম্পের আতঙ্কে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আমির শার্ট গার্মেন্টে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে দুই শতাধিক গার্মেন্টকর্মী আহত হন। ভূমিকম্প আতঙ্কে আবাসিক হলের জানালা দিয়ে লাফিয়ে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাছাড়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) পাঁচ আবাসিক হলের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

বিশ্বে ভূমিকম্পে অধিক ঝুঁকিতে থাকা ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকার ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ কংক্রিটের ভবন খুব বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ৩৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন রয়েছে মাঝারি ঝুঁকিতে। রিখটার স্কেলে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ক্ষতির মুখে পড়বে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ এলাকার মাটি নরম, বালু দিয়ে ভরাট করে ভবন তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় হবে না। নরম মাটিতে পাইলিং করার সাথে সাথে সেখানে ১০ থেকে ১৫ ফুট গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট দিয়ে মাটিকে শক্ত করতে হবে। এ রকম করা হলে সেখানে গড়ে ওঠা ভবনটি ভূমিকম্পের প্রবল ঝাঁকুনি সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করবে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই নির্ভর করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কি পরিমাণ আছে। গত এক দশকে সারা দেশে ভবনের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই বছরে গড়ে একলাখ নতুন ভবন নির্মিত হয়। এই বাস্তবতায় ভবন নির্মাণ অনুমোদনে নতুন নিয়ম চালু করতে যাচ্ছে রাজউক।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ হুমায়ুন আখতার আমার সংবাদকে বলেন, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অঞ্চলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমা হয়ে আছে। যেকোনো সময় এসব এলাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এখন যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে তা হলো বড় মাত্রার একটি পূর্ব লক্ষণ। ঝুঁকির কথা হিসাব করলে রাজধানী ঢাকা সবচেয়ে বেশি রয়েছে। ঢাকার সব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক ও ভূতত্ত্ববিদ আরও বলেন, ঢাকার বহুতল ভবনগুলো সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন জলাশয়কে মাটি ভরাট করে ভবন তৈরি করেছে ফলে ভিত্তি ততটা মজবুত নয়। তাছাড়া সরকারের প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ সন্তুষজনক নয়। জনগণের মাঝেও সচেতনতার অভাব আছে। গতকালের ভূমিকম্পনের উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে দূরে হলেও বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ঢাকা। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে তা যেকোনো সময় প্রকাশিত হতে পারে। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের দেশে ৭ স্কেলের ভূমিকম্প হতে পারে। আমাদের এই অঞ্চলে ১৫০ বছর পরপর এরকম ভূমিকম্প হয়। ঢাকাতে প্রায় পাঁচ লাখ পাকা দালান আছে। যার অধিকাংশ খুব বেশি ভালো নেই। রাজউক ও সিটি কর্পোরেশন এগুলোকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এসব ভবনগু কতটা ঝুঁকিতে আছে। 

ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী আরও বলেন, ঢাকাতে ৩৫ শতাংশ হলো ভরাট করা মাটি। সে সব জায়গাতে ভবন করার ক্ষেত্রে খুব বেশি ঝুঁকি রয়েছে। রাজউক শুধু বাইরে থেকে দেখে ভালোমন্দ বলছে কিন্তু ভবনের রড, কংক্রিট ও সার্বিক অবস্থা দেখে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। প্রকৃত কাজ করতে গেলে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ৮ স্কেলের ভূমিকম্প প্রতি ৩০০ বছর পরপর হয়। ১৮৯৭ সালে সর্বশেষ ৮ স্কেলের ভূমিকম্প হয়েছিল ফলে এটির সময় এখনো হয়নি। তবে ৭ স্কেলের ভূমিকম্প যেকোনো সময়ে হতে পারে। আমাদের এখানে প্রতিমাসে ১০-১২টি ভূমিম্পন হয়। আমাদের বাংলাদেশ ও তার আশপাশের এলাকায় মোটামুটি বলা হয় আমাদের বাউন্ডারি থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ভূমিকম্প হলে আমাদের জন্য সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদেরকে ১৮৭০ ও ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হয়েছিল। তার মানে আমাদের লং ওভার ডিউ, যেকোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে।