বছরজুড়ে আলো ছড়িয়েছে পুরুষ দল

আহমেদ হৃদয় প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩, ০৯:৪৫ এএম

 

  • সোহাগকাণ্ডে বিপাকে পড়ে ফেডারেশন
  • এ বছরই বিকেএসপিকে নিষিদ্ধ করেছে বাফুফে
  • প্রথমবারের মতো ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইয়ের  মূল পর্বে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ
  • রোনালদিনহো ও মার্টিনেজের আগমন
  •  মাদককাণ্ডে মোরসালিন, তপু, জিকোদের শাস্তি

জামাল ভূঁইয়াদের বছরজুড়ে যত ম্যাচ

ফিফা ফ্রেন্ডলি

  • বাংলাদেশ ১-০ সিশেলস
  • সিশেলস ১-০ বাংলাদেশ 
  • কম্বোডিয়া ০-১ বাংলাদেশ

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ

  • লেবানন ২-০ বাংলাদেশ 
  • বাংলাদেশ ৩-১ মালদ্বীপ
  • বাংলাদেশ ৩-১ ভুটান 
  • কুয়েত ১-০ বাংলাদেশ 

ফিফা ফ্রেন্ডলি

  • বাংলাদেশ ০-০ আফগানিস্তান
  • বাংলাদেশ ১-১ আফগানিস্তান

বিশ্বকাপ বাছাই

  • মালদ্বীপ ১-১ বাংলাদেশ
  • বাংলাদেশ ২-১ মালদ্বীপ
  • অস্ট্রেলিয়া ৭-০ বাংলাদেশ
  • বাংলাদেশ ১-১ লেবানন

বাংলাদেশের ফুটবলে আবারও প্রাণ ফিরছে। কথাটি কতটা সত্যি তা পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ফুটবলের সম্প্রতি সময়টি কেমন যাচ্ছে তা হয়তো সবারই জানা। একটা সময় ছিল তখন ফুটবলের একটা জাগরণ ছিল। নব্বইয়ের দশকেও স্টেডিয়ামে ছিল দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়। সেই ভিড় এখন কী আর দেখা যায়? হ্যাঁ, বর্তমানে স্টেডিয়ামে দর্শকদের আনাগোনা বেড়েছে। এ যেন সেই অতীতের দৃশ্য। এখন ক্লাবের ম্যাচগুলোতেও দর্শক হয়। এ বছর আলো ছড়িয়েছে বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল। আগামী মার্চের আগে জাতীয় দলের আর কোনো ম্যাচ নেই। মধ্যে জাতীয় দলটা একেবারেই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। মানুষ তো তখন বাংলাদেশ ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেত। তবে এখন আবারও সেই জাগরণ ফিরেছে বাংলার ফুটবলে। 

এ বছর পুরোটাই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছে লাল-সবুজের দামাল ছেলেরা। সর্বশেষ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ খেলেছে জামাল-তপুরা। ২০০৯ সালের পর এবার দীর্ঘ ১৪ বছর পর সাফে সেমিফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। কুয়েতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে ১-০ গোলে হেরে যায় জামালরা। মালদ্বীপ-ভুটানের বিপক্ষে শুরুতে পিছিয়ে পড়েও দারুণভাবে ম্যাচে ফিরে বড় ব্যবধানে জিতেছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে এ বছর ১৩ ম্যাচের পাঁচটিতেই জয় পেয়েছে জামাল-তপুরা। চারটি হারের বিপরিতে চার ম্যাচে রুখে দিয়েছে প্রতিপক্ষকে। দেশের মাটিতে এ বছর ছয়টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে ছয় ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছে জিকো-মোরসালিনরা। সবশেষ দেশের মাটিতে লেবাননের মতো শক্তিশালী দলকেও রুখে দিয়েছে বাংলাদেশ, তাও আবার ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে মতো বড় মঞ্চে! 

ফুটবল ফেডারশেন আলোচনা-সমালোচনা সারা বছরই থাকে। সেসব আলোচনা-সমালোচনাকে পেছনে ফেলে বছরের চলতি বছরের শুরুটা ভালোই করেছিল বাংলাদেশ ফুটবল দল। পুরো বছরে দেশে এবং দেশের বাইরে মোট ১৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল বছরের শুরুটা করেছিল জয় দিয়েই। ২৫ মার্চ সিসেলশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বছর শুরু করেন জামাল ভূঁইয়ারা। র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের থেকে পেছনের দলটিকে ১-০ গোলে হারায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। পরের ম্যাচে অবশ্য সিসেলশের কাছে হেরে বসে বাংলাদেশ। দুটি ম্যাচই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিলেটের জেলা স্টেডিয়ামে। এরপরই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে হ্যাভিয়ের কাবরেরার দল। তারই ধারাবাহিকতায় জুনে কম্বোডিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলতে তাদের দেশে যায় বাংলাদেশ। সেখানে তাদের মাঠেই কম্বোডিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয় জামাল-তপুরা। সেখান থেকেই সরাসরি ভারতে যান সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে। টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচেই শক্তিশালী লেবাননের বিপক্ষে খেলে জিকো-রাকিবরা। র্যাঙ্কিং এবং শক্তিমত্তাই বাংলাদেশের থেকে ঢের এগিয়ে দলটার বিপক্ষে জামাল ভূঁইয়ারা লড়াই করে চোখে চোখ রেখে। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে তারা হেরে যায় ২-০ গোলের ব্যবধানে। পরের ম্যাচেই মালদ্বীপের বিপক্ষে দারুণ জয় পায়। প্রথমে গোল হজম করে বসেন তারিক-তপুরা। 

তবে পরে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ঘুরে দাঁড়িয়ে মালদ্বীপকে ৩-১ গোলের ব্যবধান হারিয়ে দেন জামাল-ফাহিমরা। ভুটানকেও একই ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। সেই জয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। সেমিফাইনালে শক্তিশালী কুয়েতের বিপক্ষে লড়াই করে বাংলাদেশ। পুরো ম্যাচে সমানে সমান লড়াই করে জামাল ভূঁইয়ার দল। ৯০ মিনিটেও কোনো দলই গোল করতে পারেনি। অবশেষে অতিরিক্ত সময়ে গোল হজম করে সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে যায় বাংলাদেশ। এরপর ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের সঙ্গে দুটি ম্যাচেই ড্র করে বাংলাদেশ। এরপরই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলা নিয়ে। প্রথম ম্যাচে মালদ্বীপের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। পরের ম্যাচে ঘরের মাঠে তাদেরকে ২-১ গোলে হারিয়ে বাছাইপর্বের গ্রুপপর্ব নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। এরপর একটি দুঃস্বপ্ন ছিল বটে, তবে পরের ম্যাচেই তা ভুলে যায় সবাই। অস্ট্রেলিয়ায় তাদের বিপক্ষে ৭-০ গোলে হেরেছিল হাভিয়ের কাবরেরার দল। পরের ম্যাচে ঘরের মাঠে শক্তিশালী লেবাননকে ১-১ গোলে রুখে দেয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।

এদিকে বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং ফিফার ডিসপুট রেজ্যুলেশন চেম্বারের সাবেক সদস্য আবু নাঈম সোহাগের ওপর দুই বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয় ফিফা। বাফুফেকে দেয়া ফিফার টাকার হিসাব দেয়ার সময় মিথ্যা নথি দেয়ার কারণে ফিফার স্বাধীন নৈতিকতা-বিষয়ক কমিটির অ্যাজুডিকেটরি চেম্বার তার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আগামী দুই বছর ফুটবল বিষয়ক যেকোনো ধরনের কার্যক্রমে তিনি অংশ নিতে পারবেন না। একই সাথে তাকে ১০ হাজার সুইস ফ্র্যাঙ্ক অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ বিষয় নিয়েও তখন বেশ সরগরম ছিল বাংলাদেশের ফুটবলাঙ্গন। 

অন্যদিকে বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ফুটবল দলকে আগামী এক বছরের জন্য ঘরোয়া ফুটবলে নিষিদ্ধ করেছে বাফুফের ডিসিপ্লিনারি কমিটি। নিচের দিকের দুই লিগে বিকেএসপির খেলোয়াড়দের দুই পরিচয়ে খেলার বিষয়টি বাফুফের নজরে আসে। এরপর তারা সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে দোষ খুঁজে পায়। তারই প্রেক্ষিতে বাফুফে ডিসিপ্লিনারি কমিটি কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্যদিকে দেশের ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ২০২৬ ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাইয়ের গ্রুপপর্বে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। প্রাক-বাছাইপর্বে মালদ্বীপকে হারায় বাংলাদেশ দল। দুই লেগ মিলিয়ে ৩-২ ব্যবধানে জয় পায় জামাল ভূঁইয়ার দল। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ বাছাইয়ের মূল পর্বে উত্তীর্ণ হয় লাল-সবুজের জার্সিধারীরা। বাফুফে ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা না থাকলেও এই বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্ব ফুটবলের দুই ব্যক্তিত্ব। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতানো গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের পর এসেছিলেন ব্রাজিলের রোনালদিনহোও। ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুই সফরে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই হয়েছে বেশি। ঘরোয়া ফুটবলে ২০২৩ কিংসের ইতিহাসের বছরও। 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে টানা চার বার লিগ শিরোপার কৃতিত্ব নেই কারও। ২০১৮ সালে প্রিমিয়ার লিগে আসা বসুন্ধরা কিংস অল্প সময়ের মধ্যেই এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। বছরের মাঝামাঝিতে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপার পাশাপাশি শেষদিকে অনুষ্ঠিত নতুন মৌসুমের স্বাধীনতা কাপেও চ্যাম্পিয়ন শিরোপা অক্ষুণ্ন রেখেছে কিংস। বসুন্ধরা কিংস দেশের শ্রেষ্ঠত্বের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতেও সেরা হওয়ার দৌড়ে ছিল। ভারতের ওড়িষ্যার বিপক্ষে ড্র করতে পারলেই এএফসি কাপে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রুপসেরা হয়ে পরবর্তী ধাপে খেলত কিংস। ওই ম্যাচে রেফারির একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তে কিংসের স্বপ্নভঙ্গ হয়। যদিও এএফসি কাপে কিংস ভারতের ঐতিহ্যবাহী ও শক্তিশালী মোহনবাগানকে পরাজিত করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর আগে এএফসি কাপে মোহনবাগানকে হারানোর রেকর্ড নেই বাংলাদেশের কোনো ক্লাবের। ইতিহাস ঘটানো এএফসি কাপেই ন্যক্করজনক ঘটনাও ঘটেছে কিংসের। মালদ্বীপ থেকে ফিরে আসার পথে কিংসের ফুটবলাররা মদ বহন করেন। যার দায়ে তদন্ত করে জিকো, তপু, মোরসালিন, রিমন ও সবুজকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সবুজ বাদে বাকি চারজনের শাস্তি প্রত্যাহার হওয়ায় তারা এখন দলের সঙ্গে রয়েছেন।