বাংলাদেশ ফুটবল

নারী ফুটবলের টালমাটাল বছর

আহমেদ হৃদয় প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩, ১২:২১ এএম
  • ফেডারেশনের গাফিলতি; মিয়ানমারে দল পাঠায়নি অর্থের অভাবে
  • বছরের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামে
  • দীর্ঘদিনের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের পদত্যাগ
  • বাফুফের সাবেক টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলির চলে যাওয়া
  • পরীক্ষিত ফুটবলারদের অবসর
  • বাফুফেকে না জানিয়ে টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিলেন সাবিনারা 
  • ৩১ খেলোয়াড়ের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নতুন করে চুক্তি
  • খুলনায় নারী ফুটবলারকে মারধর

ফুটবল ফেডারেশনের গাফিলতি তো আছেই। তারমধ্যে আবার দীর্ঘদিনের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের পদত্যাগ। যে ছোটনের হাত ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মুকুট পরেছিল সাবিনা-কৃষ্ণারা। সাফ জয়ের পরই পরীক্ষিত ফুটবলারদের অনেকেই অবসর আর নিয়মিত খেলার মধ্যে থাকতে না পারার মতো নানা কাণ্ডে মেয়েদের ফুটবল ২০২৩ সালে পার করেছে টালমাটাল এক বছর। বিতর্কিত এমন একটা বছরের শেষটা ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১২ ধাপ এগিয়ে থাকা সিঙ্গাপুরকে প্রথম ম্যাচে ৩-০ গোলে হারানোর পর দ্বিতীয় ম্যাচে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে সাফজয়ী সাবিনাদের দুর্দান্ত জয় সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে। সবশেষ র্যাঙ্কিয়েও দুই ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অবস্থান এখন ১৪০তম। সোহাগকাণ্ডের সপ্তাহ দুয়েক আগেই বাফুফেতে কাঁপন ধরেছিল। মার্চে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইয়ে সাবিনাদের পাঠায়নি ফুটবল ফেডারেশন। ফেডারেশনের আর্থিক অনটনের কারণে সাফ চ্যাম্পিয়নদের খেলতে না পাঠানোর ঘটনায় তখন তীব্র সমালোচনাও হয়েছিল। এই ঘটনার রেশ ধরে দেশের দুই শীর্ষ ক্রীড়া সংস্থা বাফুফে ও বিসিবি সভাপতির বাকযুদ্ধও ছিল কয়েক দিন।

২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সাবিনা খাতুনরা। এই বছরটি তাদের অবশ্য খুব ভালো যায়নি। বছরের বেশিরভাগ সময়ই গিয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামে। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ফেডারেশনের দুই শীর্ষ কর্তা অর্ধকোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। পুরস্কার, নিয়মিত বেতন-বকেয়াসহ নানা ইস্যুতে অনুশীলন বর্জন করেছিলেন সাবিনারা। 

জাতীয় দলের মতো সাবিনাদের ঘরোয়া ফুটবলেও হয়েছে অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। নারী ফুটবলের ফ্রাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েও বাস্তবায়ন না হওয়ায় অনেক ক্ষোভ সাবিনাদের। অন্যদিকে বসুন্ধরা কিংসও নারী লিগে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে এসব নারী ফুটবলাররা গভীর সংকটে পড়েছেন।

গত বছর স্বপ্নের মতো কেটেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের। সেই তুলনায় এ বছরের অধিকাংশ সময়ই মাঠের বাইরে ছিলেন মেয়েরা। পুরো বছরে বাংলাদেশের মেয়েরা প্রথম জয় পায় ডিসেম্বরের শুরুতে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে। দ্বিতীয় ম্যাচেও তাদের ৮-০ গোলে উড়িয়ে দেয় সাবিনা-সানজিদারা। পুরো বছরে নারী দল এশিয়ান গেমসসহ ম্যাচ খেলেছে মোট সাতটি। এর মধ্যে দুটি হার, তিনটি ড্র এবং দুই ম্যাচে জয় পেয়েছে মেয়েরা। অথচ বছরে ম্যাচের সংখ্যা বাড়ার কথা ছিল, জয়টা আসতে পারত বছরের শুরুতে। ফেডারেশনের অদূরদর্শিতায় খেলতে না পারার আক্ষেপ বছরজুড়েই করেছেন নারী ফুটবলাররা। সব বিতর্কে আপাতত বিরতি পড়েছে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জয়ে। নারী ফুটবলারদের পায়ে বিল্ডআপ ফুটবলের ছোঁয়া দেখে প্রশংসাও কম নয়। লাল-সবুজ নারী দলের চাওয়া ছিল এমন; বছরের শেষ হোক ভালোভাবে। তাদের চাওয়া মতোই সবকিছু হলো। বছরের শেষ ম্যাচে সিঙ্গাপুরকে উড়িয়ে দিয়েছে ৮-০ গোলে। তবে মাঠের খেলায় ফিরেই নিজেদের সর্বোচ্চটা উজার করে দিয়েছেন সাবিনা-সানজিদারা।

২০০৯ সাল থেকে মেয়েদের ফুটবলের কোচ ছিলেন গোলাম রাব্বানী ছোটন। এই ১৪ বছরে আটটি শিরোপা জিতেছেন। রানার্সআপ ট্রফি আছে পাঁচটি। গত সেপ্টেম্বরে নেপালকে হারিয়ে সাফ শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশের মেয়েরা। দেশের নারী ফুটবলের ইতিহাসের এই অর্জনের অন্যতম কারিগর ছিলেন দেশি কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। কিন্তু হঠাৎই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

গত মে মাসে অবসরের ঘোষণা দেন সাফজয়ী কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। ১ জুন থেকে আর কোচের পদে থাকবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন তখন। ১ জুন থেকে বাফুফে ভবন ছাড়েন ছোটন। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে ছোটন হেড কোচ হলেও চাবিকাঠি মূলত ব্রিটিশ টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর পল স্মলির হাতে ছিল। ছোটন অনেক পরিশ্রম করলেও লাখ খানেক সম্মানী পান। অন্যদিকে পল স্মলি পেতেন ১৫ হাজার ডলার। সেই পল কাজের পরিবেশ নেই বলে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে আরও পাঁচ হাজার ডলার বেতন বাড়িয়ে নিলেও ছোটনদের দিকে তেমন নজর ছিল না বাফুফের। অবশেষে বাফুফের চাকরি ছেড়ে চলে যান পল স্মলি। একদিকে সাফ জয়ের পর তিন নারী ফুটবলার অবসর নিয়েছেন। গত জানুয়ারিতে অবসরে যান জাতীয় দলের দুই ফুটবলার আনুচিং মগিনি ও সাজেদা খাতুন। অবসরে গেছেন বয়সভিত্তিক দলের ফুটবলারও। মাঠে নেই নিয়মিত টুর্নামেন্ট। সিরাত জাহান স্বপ্না ও আঁখি খাতুনও জাতীয় দল ছেড়ে চলে যান। জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের স্থান পূরণ করতে সাবিনা খাতুনদের নতুন কোচ হয়েছেন সাইফুল বারী টিটু।

গত বছর প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এরপর দেশে ফিরে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু দাবি জানান নারী ফুটবলাররা। অবশেষে সাবিনা-সানজিদাদের দাবি পূরণ করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। ৩১ জন খেলোয়াড়ের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নতুন করে চুক্তি করেছে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা। নারী ফুটবলারদের দাবি ছিল মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনের। বাফুফে সেই দাবি মেনে নিয়েছে। ৩১ জন ফুটবলারের মধ্যে ১৫ জন ৫০ হাজার টাকা, ১০ জনের ৩০ হাজার, বাকি ছয় জন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া ম্যাচ ফিসহ অন্য সুবিধাদি বেড়েছে। 

অন্যদিকে খুলনায় চার নারী ফুটবলারকে মারধরের ঘটনা ঘটেছিল গত আগস্টে। এ ঘটনায় তিন আসামিকে তখন কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। উল্লেখ্য, হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলায় গত ২৯ জুলাই রাতে বটিয়াঘাটা উপজেলার তেঁতুলতলা গ্রামে চার নারী ফুটবলারকে মারধর করে নুর খাঁ ও তার পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় ৩০ জুলাই বটিয়াঘাটা থানায় চারজনের নাম উল্লেখ করে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন ফুটবলার সাদিয়া নাসরীন। পুলিশ নূর খাঁকে গ্রেপ্তার করলেও অপর তিন আসামি আদালত থেকে জামিনে ছিলেন। পরে এসিডে শরীর ঝলসে দেয়ার হুমকি দিলে সাদিয়া নাসরীন তিনজনকে অভিযুক্ত করে গত ১ আগস্ট থানায় জিডি করেন।

অন্যদিকে জাতীয় নারী ফুটবল দলের ক্যাম্পে থাকা ফুটবলাররা বিশ্রামে থাকবেন বলে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে তারা সাতক্ষীরায় খেলতে গিয়েছিলেন। অথচ এ ব্যাপারে বাফুফে নাকি কিছুই জানে না। বাফুফে তখন বলছিল, মেয়েরা ছুটি নিয়ে গেছেন বিশ্রামে থাকবেন বলে। খেলতে গেছেন সেটা তাদের জানা নাই। ছুটি নিয়ে সাবিনারা সাতক্ষীরায় খেলতে গিয়েছেন। সাবিনার বাড়ি সাতক্ষীরায় পলাশপুল মধু মাল্লারডাঙ্গিতে। এই জেলা স্টেডিয়ামেই তিনি খেলায় অংশ নেন। সাবিনা তার জাতীয় দলের খেলোয়াড়দেরও নিয়ে গিয়েছিলেন। মিয়ানমারে মেয়েদের ফুটবল দল না পাঠানোর কারণে সমালোচনা হচ্ছিল। নানা কথা ফুটবল অঙ্গনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সমালোচনার তোপে পড়ে তখন মুখ খুলেছিলেন বাফুফের সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন। হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন করে বাফুফের সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন বলেছিলেন, টাকা নাই। সংকট। দল পাঠাতে পারিনি। আসলেই টাকা নেই। বাংলাদেশ নারী ফটবল দলের পুরো বছরটা এভাবেই কেটেছে। নানা সংকট, অস্থিরতা ও নানা সমালোচনার মধ্য দিয়ে বছর পার করে নারী ফুটবল দল।