শিল্প ও আবাসিকে গ্যাস সংকট চরমে

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩, ১২:৪৪ এএম
  • চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ ২৫০ কোটি ঘনফুট
  • শিল্প খাতে উৎপাদন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ
  • আবাসিকে এলপিজি ইলেকট্রিক চুলায় ঝুঁকছেন অনেকে

সরকার আমদানি করে সরবরাহ করছে, এটি সংকট নিরসনের পথ হতে পারে না
—এম শামসুল আলম
জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব

দেশে উৎপাদন বাড়ানোয় সরকার জোর দিচ্ছে তবে রাতারাতি গ্যাস পাওয়া যাবে না
—বদরূল ইমাম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

ডিজেল ও গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমেছে বিদ্যুতের। শিল্প খাতে উৎপাদন নিম্নমুখী। মালিকদের দাবি উৎপাদন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। শীত মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা কম থাকলেও এলএনজি আমদানি কম থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ মাত্র ২৫০ কোটি ঘনফুট। ফলে শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্রাহকরা গ্যাস-সংকটে ভুগছেন। চড়া দামে বিকল্প জ্বালানি কিনে উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পের মালিকরা। গ্যাস সংকটে ধুঁকছে আবাসিক খাতও। রান্নার কাজে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন গৃহিণীরা। 

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র জানিয়েছে, দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে বড় ধরনের অসুবিধা হয় না। কিন্তু এ সরবরাহ ধরে রাখা যায়নি। দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এলএনজি আনা হচ্ছে কম। তাই এখন দিনে ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ। সরবরাহ কমলে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ এলাকার শিল্পকারখানাগুলো বেশি সংকটে পড়ে। সূত্রমতে, আগামী মার্চ নাগাদ গ্যাসের সরবরাহ বাড়তে পারে। বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় দৈনিক ১১০ থেকে ১১২ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে এ খাতে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭০ কোটি ঘনফুট। তবে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে। সংকটের সময় সাধারণত অধিকাংশ সারকারখানা বন্ধ রাখা হয়। বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এখন সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে দিনে গড়ে ২২ কোটি ঘনফুট।

অন্যদিকে উৎপাদনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র হবিগঞ্জের বিবিয়ানায় উৎপাদন কমছে। যদিও বিকল্প হিসেবে সমপ্রতি ভোলা থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করে সরবরাহ শুরু হয়েছে ঢাকার আশপাশের কিছু শিল্পকারখানায়।

নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সংখ্যা আট শতাধিক। ডাইং প্রতিষ্ঠান তিন শতাধিক। সবখানেই গ্যাসের সংকট আছে। পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত রপ্তানিমুখী ফেয়ার অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রতিদিন কাপড় উৎপাদনের ক্ষমতা ৩০ টন। এখন উৎপাদিত হচ্ছে ১০-১২ টন। এমএস ডাইং লিমিটেড বলছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। সক্ষমতা ৪০ টন হলেও উৎপাদিত হচ্ছে ১৫ টন। এদিকে রান্নার চুলা জ্বালাতে না পেরে আবাসিক গ্রাহকরা পড়েছেন বেশি ভোগান্তিতে। পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা ও লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।

নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মনসুর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে গ্যাসের চাপ ভালো থাকলেও অন্য দিন চাপ কমে যাচ্ছে। রপ্তানির স্বার্থে উৎপাদন ঠিক রাখতে শিল্পে সব সময় গ্যাস সরবরাহ রাখা দরকার। জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মামুনার রশিদ বলেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়েনি। আর তিতাস গ্যাস মুন্সিগঞ্জ কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. মেজবা উদ্দিন বলেন, মুন্সিগঞ্জে গ্যাস-সংকট দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা বশির মিয়া আমার সংবাদকে বলেন, গ্যাস সংকটে চুলা জ্বলে না। এ জন্য বিকল্প পদ্মতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত অর্থও গুনতে হচ্ছে। সারা বছরই এই সংকট থাকে তবে শীত এলে সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা ও লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে।

মুগদা এলাকার বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, পাইপলাইনের গ্যাস না থাকায় প্রতি মাসে বাড়তি এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে। আবার তিতাস গ্যাসকেও বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। মাজেদা  বেগম জানান, গভীর রাতে গ্যাস এলেও সকাল ৬টার আগে চলে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাতেও রান্নার জন্য গ্যাস পাচ্ছেন না অনেক গ্রাহক। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কলাবাগান, বসুন্ধরা, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তিতাসের অভিযোগকেন্দ্রে গ্রাহকের ফোন আসছে গ্যাস না পেয়ে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হাজেরা বেগম বলেন, মধ্যরাতে গ্যাস আসে, এরপর সকাল ৮টার মধ্যেই চলে যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাসের দাম গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়ানো হয়। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দেয়ার নামে দাম বাড়ানো হয় ১৭৯ শতাংশ। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘ঋণ করে জ্বালানি কিনছে সরকার। এটি সংকট নিরসনে কোনো সমাধান হতে পারে না। দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘গ্রাহক ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না কিন্তু প্রতি মাসে বিল দিতে হচ্ছে। লুণ্ঠন করতেই প্রি-পেইড মিটার দিতে অনীহা দেখাচ্ছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। প্রি-পেইড মিটার থাকলে বাড়তি বিল দিতে হতো না।’ 
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল বলেন, ‘বিশ্ববাজারে এলএনজির চাহিদা বাড়ছে। দাম আরও বাড়তে পারে। তাই পরিস্থিতির আপাতত উন্নতির সম্ভাবনা নেই। তিনি আরও বলেন, ‘অবশেষে সরকার দেশে উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে, যা পাঁচ বছর আগেই করা উচিত ছিল। তবে রাতারাতি গ্যাস পাওয়া যাবে না।’