তীব্র হচ্ছে নির্বাচনি সংঘাত

নুর মোহাম্মদ মিঠু প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৪, ১১:৩৩ পিএম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরোধে সৃষ্ট সংঘাতও ততই তীব্র হচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগেরই স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। গেল শুক্রবারও বরিশালে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি সভায় বরিশাল-৪ আসনের দুপক্ষের বিরোধে সংঘর্ষে একজন নিহত হন। আরও কয়েকটি এলাকা থেকে এমন সংঘর্ষের খবরও পাওয়া গেছে গত কয়েকদিনে। এমনকি প্রার্থীরা পরস্পরকে হুমকি-পাল্টা হুমকি দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। ফলে বিভিন্ন স্থানে কোন্দল ও সংঘাতময় একটি পরিস্থিতি হচ্ছে দলটির অভ্যন্তরে। 

দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩০০ আসনের মধ্যে একশরও বেশি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে ইতোমধ্যে তীব্র কোন্দল ও বিভাজন তৈরি হয়েছে দলের মধ্যে। একাদশ জাতীয় সংসদে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়া ১৮ জন সংসদ সদস্য এবার ভিন্ন প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন আওয়ামী লীগেরই মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে। নৌকা মার্কা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনি এই প্রতিন্দ্বন্দ্বিতার কারণে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, যা সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকেও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে নৌকার নির্বাচনি অফিস ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের ঠনারপাড় গ্রামে ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও গুলিবর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। একইদিন দেশের ‘আট স্থানে হামলা, ভাঙচুর গুলি, আহত ১৩’ শিরোনামেও প্রায় সব গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই খবরে বলা হয়, পাবনার ঈশ্বরদীতে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে নৌকার নির্বাচনি অফিসে হামলা-ভাঙচুর, পটুয়াখালীর গলাচিপায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের দোকান ভাঙচুর, ফরিদপুরে নির্বাচনি প্রচারে হামলার ঘটনা ঘটে। মোট আট স্থানে ১৩ জন আহত হন। এদিকে জামালপুরে এক সাংবাদিককে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যস্থতায় প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কোলাকুলি করে ‘আর সংঘাতে না জড়ানোর’ প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরদিনই ফের সহিংসতা হয়েছে রাজশাহীর বাগমারায়। জয়পুরহাট-২ আসনে ক্ষেতলাল উপজেলায় নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ উভয় পক্ষের পাঁচজন আহত হয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে নির্বাচনকে ভোট উৎসব বলেই ধরা হয়। 

নির্বাচনি উৎসবে প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা নানা আয়োজনে ভোট প্রার্থনায় নামে। পথসভা, কর্মিসভার আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাড়া-মহল্লায় চলে নির্বাচনি প্রচার। প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে প্রার্থী এবং তাদের অনুসারীরা ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে বাদ্য বাজিয়ে অনেকেই মিছিল করে। এবার সেই উৎসবমুখর পরিবেশ সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনাও। শুধু তাই নয়, এবারই প্রথম চোখে পড়ার মতো নির্বাচনি কার্যালয়ে আগুনের ঘটনা ঘটছে। গতকালও কক্সবাজার-১ আসনের চকরিয়ার কৈয়ারবিল এলাকায় কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের হাতঘড়ি প্রতীকের নির্বাচনি অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় অফিসের চেয়ার, টেবিল, পোস্টারসহ ও পাশে থাকা একটি সার-কীটনাশকের দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদিও হাতঘড়ি প্রতীকের প্রার্থীর অভিযোগ স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক প্রতীকের সমর্থক কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মক্কী ইকবাল হোসেন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। 

এছাড়াও শুক্রবার রাতে রাজশাহী-১ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির একটি নির্বাচনি কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রোববার রাতে মাহির মামাতো ভাই জাহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। মামলার সব আসামিই নৌকা প্রতীকের সমর্থক। এছাড়াও প্রচারণা শুরুর পর থেকেই শরীয়তপুরসহ আরও একাধিক স্থানে নির্বাচনি কার্যালয়ে অগিগ্নসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। যা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি।

এদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার আত্মীয় এবং চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরীর ভাই মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। তাদের ঘিরে সেখানে আগে থেকেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। দুই প্রার্থীর মধ্যে একে অপরকে বিভিন্নভাবে হুমকি প্রদানের ঘটনা ঘটেই চলছে। মাদারীপুরের একটি আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষ ও বিরোধ ইতোমধ্যেই আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ঢাকার কাছেই শরীয়তপুরের একটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সরকারের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন খালেদ শওকত। এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অতীতে একাধিকার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন খালেদ শওকতের বাবা প্রয়াত কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শওকত আলী। তিনি এক সময় জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকারও ছিলেন। তাদের দুজনকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে দলীয় নেতা-কর্মীরা। গত কয়েকদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলা-পাল্টা হামলার অভিযোগ করছেন। 

ঢাকার কাছে সাভারে সরকারের ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ওই আসনের সাবেক এমপি তালুকদার মোহাম্মদ তৌহিদ জং মুরাদ। ওই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারাও দুই প্রার্থীকে ঘিরে ভাগ হয়ে গেছেন এবং এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। চাঁদপুর জেলার প্রার্থীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার যে ভার্চুয়াল সভা করেছেন সেখানে জায়গা পাননি ওই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় প্রার্থীদের অভিযোগ হলো তারা জেলার প্রতিটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য কাজ করছেন। পিরোজপুরে মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ওই এলাকার আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি এ কে এম আউয়াল। ইতোমধ্যেই দুগ্রুপের সংঘর্ষে সেখানে একজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। মুন্সীগঞ্জের একটি আসনে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে গত ১৮ ডিসেম্বর বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। 

ময়মনসিংহ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নিলুফার আনজুমের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন দলেরই জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ হাসান অনু। ফরিদপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শামীম হক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে এখনো আলোচিত সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও কুমিল্লা-১১ আসন চৌদ্দগ্রামেও সাবেক রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের শঙ্কা রয়েছে স্বতন্ত্রপ্রার্থী সাবেক পৌর মেয়র মিজানুর রহমানের কর্মীদের।  

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, চলমান নির্বাচনি সংঘাত থামাতে আওয়ামী লীগকে কঠোর অবস্থানে যাওয়া উচিত। যেহেতু মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নির্বাচন করা প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগেরই লোক। অন্যথায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নির্বাচন কমিশনেরও উচিত আগ্রাসী কিংবা বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচনে অংশ নেয়া মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সবই আওয়ামী লীগেরই। নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ানো কখনোই কাম্য নয়। এছাড়া নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার এমন পরিবেশ কখনোই সুফল বয়ে আনে না। তবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন গণমাধ্যমকে বলছেন, পুরো বিষয়টিই নির্বাচনকেন্দ্রিক এবং নির্বাচনের পর এসবের রেশ থাকবে না বলেই মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর দেখবেন এসব আর নেই। তখন সবার ক্ষোভ, আশঙ্কা সব দূর হয়ে যাবে।