ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাড়ছে

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রকাশিত: মে ১০, ২০২৪, ০২:৫৯ পিএম

দেশে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার। আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার বিশ্বের যে কোনো ডেঙ্গু প্রকোপ দেশের চেয়ে বেশি। এর কারণ হিসেবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া, মশক নিধনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার না করা, চিকিৎসায় সংকটসহ কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের ইতিহাস দুই যুগ আগের। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল পাঁচ হাজার ৫৫১ জন আর মৃত্যু হয়েছিল ৯৩ জনের। 

তারপর ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর আক্রান্ত ও মৃত্যুহার কখনও বেশি বা কম থাকলেও ২০২৩ সালে দেশে রেকর্ড পরিমাণ তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন আর এতে মৃত্যু হয়েছিল এক হাজার ৭০৫ জনের— যা ২০০০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর চেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৯ মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল এক হাজার ৪৪ জন ও মৃত্যু হয়েছিল ১১ জনের। একই সময়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন দুই হাজার ৩৬০ জন ও মৃত্যু হয় ২৮ জনের।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে দ্বিগুণ হারে। দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪২৮। এর মধ্যে মারা যান ১০৫ জন। মৃতের হার ছিল শূন্য দশমিক ৩৭। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে মারা যান ২৮১ জন। মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৪৫। ২০২৩ সালে মৃত্যুহার বেড়ে হয় শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২৪ সালের গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় মৃত্যুহার এক দশমিক ১৫। মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে জ্বর হলে গুরুত্ব না দেয়া, হাসপাতালে দেরি করে আসাকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর আসল কারণ জানতে ডেথ রিভিউ বা মৃত্যু পর্যালোচনা করতে হবে। ডেথ রিভিউ করা হলে বিষয়টি পরিষ্কার করা সম্ভব হতো। গত বছরের মাঝামাঝি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মৃত্যু পর্যালোচনার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পর্যালোচনা শেষ করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কোনো বিশ্লেষণও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। দেশে শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নেয়া রোগীদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আক্রান্ত হয়ে বাসায় চিকিৎসা নেয়া রোগীদের সংখ্যা জানা গেলে রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে। আক্রান্তদের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলে যে কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণও কঠিন হয়ে পড়ে।

এদিকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকা স্থানীয় সরকার বিভাগ ব্যয় করছে। কিন্তু কার্যকর কোনো ফলাফল দেখা যাচ্ছে না। গতানুগতিক পদ্ধতিতে মশক নিধনের যে কার্যক্রম চলছে, এতে মশা খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই এখন বিজ্ঞানসম্মতভাবে মশক নিধন জরুরি হয়ে পড়েছে।

কীটতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর সময়কাল এখন আগের মতো নেই। এডিস মশা আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে বংশবৃদ্ধির ধরনও বদলেছে। ডেঙ্গু আমাদের দেশে বর্ষাকালীন রোগ ছিল। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু সারা বছরের রোগে পরিণত হচ্ছে। বর্ষায় বাড়ছে আর শীতে কমছে। এক সময় বলা হতো এডিস মশা রাতে কামড়ায় না; কিন্তু এখন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এডিস মশা রাতেও কামড়াচ্ছে। সবচেয়ে বড় শঙ্কার কারণ ডেঙ্গু নগরের রোগ থেকে এখন সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের প্রচলিত এডিস মশা নিধন পদ্ধতি পরিবর্তন জরুরি। দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা না করলে ডেঙ্গু দেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

দেশে ডেঙ্গুর মৃত্যুহার ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ডেঙ্গু এমন একটি রোগ— যা নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। ডেঙ্গুর চিকিৎসা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশা যেন বংশবৃদ্ধি না করতে পারে, তার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ কাজ করছে। আমরা দুই মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে একসঙ্গে কয়েকটি সভা করেছি। আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। এবার ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রণ করব। ডেঙ্গু চিকিৎসায় যতই হাসপাতাল প্রস্তুত রাখি না কেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা যদি নাগরিক সচেতনতা না বাড়াতে পারি, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। আমাদের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা রয়েছে। আমাদের  চিকিৎসকরা ডেঙ্গু চিকিৎসায় অত্যন্ত দক্ষ। আমি সবাইকে একটি অনুরোধ করব, জ্বর হলে সবাই যেন  চিকিৎসকদের পরামর্শ নেন। দেরি করলেই মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া এবার স্যালাইনসহ ডেঙ্গু চিকিৎসাসহায়ক কোনোকিছুর সংকট হবে না। আশা করি চলতি বছর আমরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু কমাতে পারব।