ভারতকে ‘সমুচিত জবাব’ দিতে সশস্ত্র বাহিনীকে পাকিস্তানের অনুমতি
‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ফ্রান্সের বার্তা
অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতির দাবি প্রত্যাখ্যান ভারতের
হামলায় মাসুদ আজহারের ১০ স্বজন নিহত দাবি ভারতের
কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারতে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ভারত শাসিত কাশ্মীরে অন্তত ১৫ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছেন এবং ৪৩ জন আহত হয়েছেন। দিল্লির বিমান হামলার জবাবে দেশ দুটির মধ্যে কার্যত সীমান্ত হিসেবে পরিচিত এলাকায় পাকিস্তান যখন ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে, তখন এই ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গুলিবর্ষণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে পুঞ্চ এবং মেন্ধার এলাকায়। বাড়ি এবং দোকানপাটসহ অনেক ভবন গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুঞ্চের স্থানীয় সাংবাদিক জামরুদ মুঘল ফোনে বলেন, গতকাল বুধবার রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি। মানুষ পুরো রাত ঘুমাতে পারেনি। সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে গেছে। আমাদের স্থানীয় হাসপাতাল এখন আহত মানুষে ভরে গেছে।
অন্যদিকে মঙ্গলবার মধ্যরাতে চালানো ভারতের হামলায় পাকিস্তানে নিহত বেড়ে ২৬ জনে দাঁড়িয়েছে। ওই হামলায় ৪৬ জন আহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে দেশটি। গতকাল সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেন, ভারতের হামলায় ছয়টি এলাকায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৬ জনে দাঁড়িয়েছে এবং ৪৬ জন আহত হয়েছে।
ভারতকে ‘সমুচিত জবাব’ দিতে সশস্ত্র বাহিনীকে পাকিস্তানের অনুমতি : জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। দেশটি হুঁশিয়ার করে বলেছে, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন ও বেসামরিক লোকজনকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে সময়মতো ভারতের বিরুদ্ধে জবাব দেয়ার অধিকার রাখে তারা। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর দেয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, নিজেদের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার জন্য পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে, পাকিস্তান ভারতের ওই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের প্রতি শোক জানিয়েছে তারা।
ভারতের হামলাকে ‘উসকানিমূলক ও কাপুরুষোচিত’ উল্লেখ করে ইসলামাবাদ বলেছে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার সমুচিত জবাব দেয়া হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের আগ্রাসন থেকে নিজ দেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করেছে।
‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ রাশিয়া, যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সের বার্তা : দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পাকিস্তানের বেশ কিছু স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় নরেন্দ্র মোদির দেশ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্বনেতারা। এরই মধ্যে বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো আন্তর্জাতিক পরাশক্তিরা।
এবার ভারত-পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনা নিয়ে বার্তা দিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনীর বাকি তিন দেশ রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।
এক বিবৃতিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ‘ক্রমবর্ধমান সামরিক সংঘাতের ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ রাশিয়া। দেশ দুটিকে সংযম দেখানোর আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাশিয়া সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা করে এবং এর যে কোনো মদতের বিরোধিতা করে। এই খারাপ কাজকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টাকে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় দেশটি। আশা করা হচ্ছে, দিল্লি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে বিদ্যমান মতবিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা যাবে, রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক সমাধানের পক্ষে কথা বলছে।’
এদিকে, ভারত-পাকিস্তানের চলমান দ্বন্দ্বকে চরম উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাজ্যও।
দেশটির পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড লেমি বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্য সরকার ভারত ও পাকিস্তানকে সংযম প্রদর্শন এবং দ্রুত, কূটনৈতিক পথ খুঁজে বের করার জন্য সরাসরি সংলাপে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে।’ এই যুদ্ধে কেউই জিতবে না বলেও মনে করেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব, ‘আমি ভারত ও পাকিস্তানকে আগেই স্পষ্ট করেছি, এই অচলাবস্থা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে কেউই জিতবে না।’
ভারত ও পাকিস্তানকে সংযম প্রদর্শন করতে বলেছে নিরাপত্তা পরিষদের আরেক সদস্য দেশ ফ্রান্সও। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যারোট বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ভারতের আকাঙ্ক্ষা আমরা বুঝতে পারি। তবে আমরা স্পষ্টতই ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছি যাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায় এবং অবশ্যই বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়া যায়।’
অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতির দাবি প্রত্যাখ্যান ভারতের : ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তানে চালানো হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ঘটনায় পাকিস্তানের দাবিটি মিথ্যা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাজনাথ সিং দাবি করেছেন, পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ভারতের রাতের আক্রমণে বেসামরিক নাগরিকদের কোনো ক্ষতি হয়নি। বেসামরিক হতাহতের পাকিস্তান সরকারের দাবির বিরোধিতা করে তিনি বলেন, আমরা কেবল তাদেরই আঘাত করি যারা নিরপরাধদের হত্যা করে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্দেশনায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী আমাদের সবাইকে গর্বিত করেছে।
এর আগে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি একটি বিবৃতি জারি করে। তাতে ভারতের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক আক্রমণ করার অভিযোগ আনে।
বিবৃতিতে বলা হয়, কল্পিত সন্ত্রাসী শিবিরের উপস্থিতির মিথ্যা অজুহাতে ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক এলাকাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে ভারত।
ভারতীয় হামলায় মাসুদ আজহারের ১০ স্বজন নিহত : ভারতীয় বিমান হামলায় জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ (জেইএম) গোষ্ঠীর প্রধান মাসুদ আজহারের পরিবারের ১০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। নিহতদের মধ্যে পাঁচ শিশু রয়েছে। মাসুদ আজহার গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, কাপুরুষ মোদি নিরীহ শিশু, অবিবাহিত নারী ও বয়স্কদের টার্গেট করেছে। এই শোক ও বিস্ময় ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
তিনি জানান, নিহতদের মধ্যে তার বড় বোন, দুলাভাই, ভাতিজা ও ভাতিজিও রয়েছেন। ভারতের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের ৯টি স্থানে ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, হামলাগুলোতে কোনো বেসামরিক ব্যক্তি বা সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। তবে পাকিস্তান জানিয়েছে, দেশটির ছয়টি ভিন্ন এলাকায় হামলাগুলোর লক্ষ্য ছিল বেসামরিক এলাকা ও উপাসনালয় এবং এতে বহু সাধারণ নাগরিক হতাহত হয়েছেন।