ইশরাক সমর্থকদের আন্দোলনের ১৮ দিন

ভয়াবহ বিপর্যয়ে নাগরিক সেবা

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২৫, ১২:০৮ এএম

রেহেনা বানু, ছেলেকে নিয়ে গোলাপবাগ মোড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-৫ এ এসেছেন জন্মনিবন্ধন সংশোধন করাতে। কিন্তু কার্যালয়ের গেটেই বসে থাকা দুজন আনসার সদস্য সাফ জানিয়ে দিলেন অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউই নেই। গত ৮-৯ দিন ধরেই অফিস খোলা, কিন্তু কার্যক্রম নেই। কেউ আসেই না। 

একইভাবে ধলপুরে সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব শাখা ৯-এ এসেছেন হারুন মিয়া নামের একজন। তিনি এসেছেন ট্রেড লাইসেন্স করাতে। কিন্তু অফিসের গেটেই বসে থাকা এক বৃদ্ধ নারী জানালেন ভেতরে কেউই নেই। অফিস খোলা থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউই নেই। 

গত ৮-৯ দিন ধরে ঠিক একই অবস্থা চলছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয়সহ সবকটি আঞ্চলিক কার্যালয় ও রাজস্ব দপ্তরেও। এতে নাগরিক সেবায় শুধু ভোগান্তিই নয়, বরং বড় ধরনের বিপর্যয়ও নেমেছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কর্পোরেশনে আসা সেবাগ্রহীতারা। 

ভোগান্তিতে পড়া সেবাগ্রহীতারা বলছেন, আগে এক দল খেয়ে গেছে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো। বর্তমানে আরেক দল উঠে পড়ে লেগেছে লুটপাটের জন্য। মাঝে আমরা সাধারণ মানুষরা পড়েছি বিপাকে।

এমন সমস্যার সূত্রপাত ঘটে মূলত বিএনপি নেতা ইশরাকের মেয়র পদ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায়। শুরুতে শপথ গ্রহণের দাবিতে আন্দোলনে নামে ইশরাকের সমর্থকরা। পরে হাইকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে শপথ গ্রহণে বাধা না থাকার কথা উল্লেখ করে রায় পেলেও পরবর্তীতে এ নিয়ে ফের লিভ টু আপিল করা হয়। যে কারণে শপথ গ্রহণ আবার আটকে যায়। কিন্তু নাছোড়বান্দা ইশরাকের সমর্থকরাও তা মানতে নারাজ। তারা এখন ইশরাককে সরাসরি মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। যে আন্দোলনে জোট বেঁধেছে ডিএসসিসির কর্মচারীদের একটি অংশ। আর এতে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়সহ সবকটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে নাগরিক সেবায় নেমেছে স্থবিরতা। জরুরি সেবাও মিলছে না সংস্থাটিতে।

জানা গেছে, নগর ভবনে টানা অবস্থান কর্মসূচি পালনের মধ্যে মূল ফটক আটকানোর পাশাপাশি সব বিভাগের গেটে তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে গতকালও বন্ধ থাকে সব সেবা কার্যক্রম। মূল ফটকে তালা লাগানোর পাশাপাশি নগর ভবনের ফটকগুলোতে এখনও তালা ঝুলছে। প্রধান কার্যালয় থেকেও সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন ও ঢাকাবাসীর ব্যানারে ইশরাকের সমর্থকরা নগর ভবনের ভেতরের ফটকে অবস্থান নিয়ে কিছুক্ষণ পরপর নগর ভবন প্রাঙ্গণে মিছিল করছেন। 

তাদের আন্দোলনের ফলে গেল ১৫ মে থেকে নগর ভবন থেকে দেয়া সব নাগরিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্য খোরশেদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, দুই দফায় কোর্ট রায় দেয়ার পরও ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে দেয়া হচ্ছে না। আমরা ইশরাককে মেয়র হিসেবে পেতে চাই। এই দাবিতেই আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।

সামগ্রিকভাবে আন্দোলনকারীরা বলেন, ঢাকার জনগণ যেমন ইশরাক ভাইকে মেয়র হিসেবে দেখতে চায়, ঠিক তেমনি ডিএসসিসির সব কর্মচারীও তাকে মেয়র হিসেবে চায়। গত ১৫ মে থেকে আমরা টানা কর্মসূচি পালন করে আসছি। যে কারণে সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ আছে। আমাদের মেয়র, জনগণের মেয়র ইশরাক ভাই দায়িত্ব গ্রহণ করলে মেয়র হিসেবে বসলে আমরা কাজে ফিরে যাব। তা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবেই। এ সময় তারা ‘শপখ শপথ শপথ চাই, ইশরাক ভাইয়ের শপথ চাই’, ‘মেয়র নিয়ে তালবাহানা, সহ্য করা হবে না’, ‘চলছে লড়াই চলবে, ইশরাক ভাই লড়বে’ এমন স্লোগান দিতে থাকেন।  

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গেল ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল সেই ফল বাতিল করে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে। এরপর ২৭ এপ্রিল ইশরাককে ডিএসসিসি মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তাকে যেন শপথ পড়ানো না হয় সেজন্য গত ১৪ মে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে গত ১৫ মে থেকে আন্দোলনে নামেন ইশরাক সমর্থকরা। 

তাদের আন্দোলনের কারণে ডিএসসিসি নগর ভবন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। কিন্তু আইনি জটিলতার কথা বলে ইশরাকের শপথের আয়োজন থেকে বিরত থাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এরপর এ রিট মামলার ওপর কয়েক দফা শুনানির পর বৃহস্পতিবার তা খারিজ করে আদেশ দেন হাইকোর্টের বেঞ্চ। এরপর শপথ পড়ানোর জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন ইশরাক।