নতুন করে সংকটের মুখে দেশের পোশাক খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: জুন ১৫, ২০২৫, ১২:১৩ এএম

দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়ের উৎস তৈরি পোশাক খাত নতুন করে সংকটের মুখে পড়েছে। বিগত এক বছরে এ খাত ১০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেখালেও সাম্প্রতিক সময়ে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে ভারতের বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা মিলিয়ে খাতটি চরম চাপের মধ্যে রয়েছে। 

দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের জোগান দেয় তৈরি পোশাক খাত। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এই খাতেই। কিন্তু গত ১৭ মে ভারত সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারতের এই সিদ্ধান্ত আসে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একই পথ দিয়ে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায়। ফলে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের প্রায় ৪২ শতাংশ রপ্তানি প্রভাবিত হচ্ছে। এখন সমুদ্রপথ ছাড়া বিকল্প নেই, যা সময়সাপেক্ষ এবং খরচসাপেক্ষ। 

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। এই হার ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত এই শুল্ককে অন্যায্য বলেছে কিন্তু তা এখনও কার্যকর রয়েছে। 

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, দেশীয় ও বৈশ্বিক নানা সমস্যা একত্রে খাতটিকে বিপদে ফেলেছে। গ্যাস ও জ্বালানির সংকট, উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি, উচ্চ সুদের হার, নীতিগত সহায়তার অভাব এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা সব মিলে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। 

হাতেম বলেন, গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় অনেক টেক্সটাইল মিলে উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে। এর পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি ও ধারাবাহিক ধর্মঘটে ব্যবসায়িক কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়মিত প্রতিবাদ ও ধর্মঘট চলছে। সরকারি চাকরিজীবী ও পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবির কারণে রাস্তায় নামছে হাজারো মানুষ। এই অস্থিরতার কারণে সরকার বাণিজ্যনীতি নিয়ে মনোযোগ দিতে পারছে না বলেও অভিযোগ করেছেন মোহাম্মদ হাতেম। এই সব চাপের মধ্যেও জুলাই ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এই সময়ে মোট রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৩২.৬৪ বিলিয়ন ডলার। যা তৈরি পোশাক খাতের সক্ষমতা এবং উদ্যোক্তাদের কঠোর পরিশ্রমের প্রমাণ। 

হাতেম বলেন, আমাদের উদ্যোক্তারা উদ্ভাবনী এবং দক্ষ। তারা ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে পেরেছেন। তবে বড় কারখানাগুলো টিকে থাকলেও ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

ফারুক হাসান বলেন, ছোট কারখানাগুলোর দিকে এখনই নজর না দিলে ভবিষ্যতে বড় সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি মনে করেন, এই প্রবৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ী নেতারা ২০২৬ সালের নভেম্বরে নির্ধারিত এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ পেছানোর দাবি তুলেছেন। কারণ এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে, বাংলাদেশ অনেক বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে। যা রপ্তানি খাতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। 

তবে আশার কথা হচ্ছে, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তিন বছর, চীন দুই বছর এবং কানাডা ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে। 

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন এই সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এর ফলে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাও বন্ধ হয়ে গেছে। যা বাংলাদেশি পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহে বড় বাধা তৈরি করছে। 

বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান বলেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হওয়ায় পণ্য পাঠাতে সময় ও খরচ বেড়ে গেছে। বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারত হয়ে ৩৬টি দেশে ৩৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। 

এর বাজারমূল্য প্রায় ৪৬২.৩৪ মিলিয়ন ডলার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন দক্ষতা বাড়াতে হবে। পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকেও অগ্রসর হতে হবে। 

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন এক নতুন সন্ধিক্ষণে। দীর্ঘমেয়াদে এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য নীতিতে দৃঢ়তা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমঝোতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। না নহলে একসময় এই অগ্রগতি থমকে যেতে পারে।