আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার হবে না ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। তবে ১৫ বছর পর ফের চালু হচ্ছে ‘না’ ভোটের বিধান। যেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী থাকলেও তাকে ভোটারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পাশাপাশি, প্রয়োজনে দেশের সবকটি ৩০০ আসনের ফলাফলও বাতিল করার মতো অভূতপূর্ব ক্ষমতা পাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইসির প্রধান কার্যালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান কমিশনার আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে আইন ও প্রক্রিয়ায় বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে সীমিত আকারে ইভিএম ব্যবহার হলেও এবার সম্পূর্ণভাবে হাতে লেখা ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট হবে। কমিশন সূত্র জানায়, প্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিতর্ক, ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ সমস্যা এবং ভোটগ্রহণের স্বচ্ছতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ভোটারদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছিল।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম চালু হয়েছিল ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা, যা ২০১১ সালে বাতিল হয়। এবার ফের চালু হলেও এটি সীমিত আকারে প্রযোজ্য হবে— শুধুমাত্র একক প্রার্থী থাকলে। অর্থাৎ, কোনো আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী থাকলেও তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিজয়ী হবেন না; তাকে অবশ্যই ভোটের মাঠে গিয়ে জনগণের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এর মুখোমুখি হতে হবে। কমিশন বলছে, এ পদক্ষেপ প্রার্থীদের ভোটারদের কাছে যাওয়ার চাপ বাড়াবে এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করবে।
নতুন প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী, নির্বাচন চলাকালে বা পরে অনিয়ম, জালিয়াতি বা সহিংসতার প্রমাণ মিললে ইসি সরাসরি পুরো আসনের ভোট বাতিল করে পুনঃভোটের নির্দেশ দিতে পারবে। প্রয়োজনে এই ক্ষমতা ৩০০ আসনেই প্রয়োগ করা যাবে। এর আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সাধারণত আদালতের মাধ্যমে হতো।
এবার সশস্ত্র বাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন পুলিশের পাশাপাশি। সমান ভোট পড়লে লটারির পরিবর্তে পুনরায় ভোট হবে। প্রতিটি প্রিজাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় থাকবে সশস্ত্র আনসার সদস্য।
জোটভুক্ত দলগুলোকে নিজ নিজ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করা হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচনের পরও ওই এমপির পদ বাতিল করা যাবে— এমন বিধানও রাখা হচ্ছে। কমিশনের ভাষ্যে, এটি প্রার্থীদের আর্থিক ও ব্যক্তিগত তথ্যের স্বচ্ছতা বাড়াবে।
বড় রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে মাঠপর্যায়ে সহিংসতা ও প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব রোধ না করা গেলে আইনের পরিবর্তন ফলপ্রসূ হবে না। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো বলছে, ‘না’ ভোট ও ফল বাতিলের ক্ষমতা ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও বাস্তবায়নের সময় রাজনৈতিক চাপ সামলানোই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইভিএম বাদ দিয়ে হাতে লেখা ব্যালটের দিকে ফেরার ফলে ভোট গণনায় সময় লাগবে, তবে স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে পারে। ‘না’ ভোট ফেরানো ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়াবে, বিশেষ করে যেখানে প্রার্থী সংকট থাকে। তবে তারা সতর্ক করেছেন, আইনের প্রয়োগে কঠোরতা এবং মাঠপর্যায়ে নিরপেক্ষ প্রশাসন ছাড়া কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘না’ ভোটের হার গড়ে ছিল প্রায় ৫ শতাংশ। সে সময় একক প্রার্থী থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ভোটাররা ‘না’ ভোট দিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। পরে রাজনৈতিক চাপের মুখে বিধানটি বাতিল হয়। এবার পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে ভোটারদের হাতে নতুন করে প্রতিবাদের সুযোগ ফিরছে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, সব পরিবর্তন সংবলিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সংসদে অনুমোদন পেলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা কার্যকর হবে।