দেশের শেষ সীমান্তবর্তী এলাকা নেত্রকোনার জেলার দুর্গাপুর উপজেলা। পাহাড়-বনের এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও বনভূমির বর্তমান চিত্র আর আগের মতো নেই। এক সময়ের বিশাল বনভূমি এখন অনেকটাই উজাড় হয়ে গেছে। এ বনের মূল্যবান গাছের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত ঠাঁই নিয়েছে করাতকলে। শুধু তাই নয়, গ্রাম-শহরের ফলদ ও বনজ বিভিন্ন প্রজাতির গাছও নির্বিচারে কেটে চিরাই করা হচ্ছে এসব করাতকলে।
নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রশাসনের চোখের সামনে সীমান্তবর্তী এই উপজেলায় অবৈধ করাতকলের বিস্তার ঘটেছে। এসব করাতকলের কার্যক্রমে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
উপজেলা বন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাপুর পৌরসভা, কুল্লাগড়া, চন্ডিগড়, বিরিশিরি, বাকলজোড়া, কাকৈরগড়া ও গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নে বর্তমানে ৪৪টি করাতকল রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদন বা লাইসেন্স পেয়েছে মাত্র ৭টি, বাকি ৩৭টি করাতকল চলছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। এর মধ্যে ১৪টি করাতকলের লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়লেও এখনো অনুমোদন মেলেনি। আবার অনেক করাতকল লাইসেন্স ছাড়াই বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছে, যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বন আইনের বিধান অনুযায়ী, কোনো করাতকল মালিক লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে এ নিয়ম পুরোপুরি উপেক্ষিত হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন বিভাগের কিছু অসাধু ব্যক্তি করাতকল মালিকদের কাছ থেকে সরকারি অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা আদায় করেন। এতে সরকার হারাচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব, আর লাভবান হচ্ছেন অসাধু ব্যক্তি ও করাতকল মালিকরা।
সরেজমিন দেখা যায়, এসব করাতকলের অধিকাংশই প্রধান সড়কের পাশেই স্থাপিত। করাতকল মালিকরা রাস্তা দখল করে ছোট-বড় গাছের স্তূপ রাখছেন, যা পথচারী ও যানবাহনের চলাচলে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে এমনকি রাস্তারও ক্ষতি হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ব্যক্তি বলেন, কিছু করাতকল মালিক প্রভাবশালী। এ কারণে বছরের পর বছর লাইসেন্স ছাড়াই নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালাতে পারছেন তারা। তবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে প্রশাসনের কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পরিবেশবাদী পল্টন হাজং বলেন, অবৈধ করাতকলগুলোতে অপরিপক্ব গাছ এনে চেরাই করা হচ্ছে, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রশাসনের উচিত দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
শিমুলতলী গ্রামের করাতকল মালিক মঞ্জুর কাদের সোহেল বলেন, তিনি এখনো লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেননি, তবুও পল্লীবিদ্যুৎ অফিস থেকে সহজেই সংযোগ পেয়ে করাতকল চালাচ্ছেন। অন্যদিকে উপজেলার সাতাশি গ্রামের করাতকলের মালিক আব্দুল রউফ বলেন, তিনি লাইসেন্স ছাড়াই করাতকল কিনেছিলেন, পরিচালনাও করেছেন কিন্তু তিনি দাবি করেন, গত এক বছর আগে বিক্রি করে দিয়েছেন, অথচ বন বিভাগের হালনাগাদ তালিকায় এখনও তার নাম বদ্যিমান।
পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির দুর্গাপুর জোনাল অফিসের ডিজিএম মো. হাফিজুর রহমান বলেন, সংযোগগুলো পুরাতন সংযোগ সে-সময় নিয়ম ছিল না। তবে বর্তমানে অবৈধ করাতকল মালিকদের এক মাস সময় বেঁধে চিঠি দেয়া হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লাইসেন্স করতে না পারলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
উপজেলা বন কর্মকর্তা মজনু প্রামাণিক বলেন, চাঁদা আদায়ের বিষয়ে আমার জানা নেই, আমি নতুন এসেছি। তবে ইতোমধ্যে অবৈধ ১২টি করাতকলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের জন্য পল্লীবিদ্যুৎ অফিসে চিঠি পাঠানো হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব করাতকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা আফসানা বলেন, খুব শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এসব অবৈধ করাতকল বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।