Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ভাষা সৈনিক পরিবারের তিন বোনের রাষ্ট্রীয় মুল্যায়ন চায় পরিবার

এইচ ডি রুবেল, কুলাউড়া

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০, ০২:২৬ পিএম


ভাষা সৈনিক পরিবারের তিন বোনের রাষ্ট্রীয় মুল্যায়ন চায় পরিবার

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল মাতৃভাষাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জাতীয় আন্দোলন। জাতীয় এই আন্দোলনে বাংলাকে রাষ্টীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে সব প্রতিবাদী নারী নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ একজনের নাম ছালেহা বেগম।

১৯৫২ সালে ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। জন্ম-১৯৩৫ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর। বাড়ি সিলেট অঞ্চলের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার উছলাপাড়া গ্রামে। বাবা সাব রেজিষ্টার এ এম আশরাফ আলী সরকারি চাকরির কারণে ঐ সময়ে পিরোজপুরে পোষ্টিং ছিল। তিন বোন ও দু'ভাই এর মধ্যে ছালেহা বেগম তৃতীয়। বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকতেন।

দর্শনে অনার্স পড়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসাবে ছাত্র রাজনীতি ও তখনকার চলমান মাতৃভাষা আন্দোলনের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। মেজো বোন হোসনে আরা বেগম ১৯৪৮ সালে পিরোজপুর আরবান গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। কায়েদে আজম ঢাকায় এসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৪৮ ‍সালের ১১ মার্চ স্কুল থেকে ধর্মঘটের আহ্বান করায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন।

ছালেহা বেগমকে ময়মনসিংহে থাকতে হতো স্কুলের হোস্টেলে। সেখানকার অভিবাবক হিসেবে ছিলেন তাদের মামা। সি এ মান্নান যিনি বন বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে ময়মনসিংহে কর্মরত ছিলেন। ছালেহা বেগম এর পরিবার ছিল শিক্ষানুরাগী ও রাজনীতি সচেতন। ছালেহা বেগম ছিলেন দশম শ্রেণীর অন্যতম মেধাবী ও সাহসী ছাত্রী। তিনি ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের খেলাধুলা ও সাতারে চ্যাম্পিয়ন থাকার সুবাদে সবকিছুতেই অগ্রনী ভূমিকা পালন করতেন। ছোট ক্লাসের মেয়েরাও ছালেহা বেগমকে তাদের বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করত।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। শহীদ হন অনেকে। সর্বত্র বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ময়মনসিংহেও। ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীরা সেদিন ক্লাসে যোগ দেয়নি। তারা বিদ্যালয়ে উঠিয়ে দেয় কালো পতাকা। মিছিল বের করে কালো পতাকা হাতে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে তারা।
ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করার মূল কারিগর ছিলেন এই ছালেহা বেগম। কালো পতাকা হাতে নিয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিদ্যাময়ী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা খানমের কঠিন প্রহরা ভেঙ্গে সেই স্কুলের ছাত্রীদের ও মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীদেরকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে মূল আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুসলিম গার্লস হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছালেহা বেগম একাই কাধে তুলে নেন মেয়েদের নেতৃত্বের কঠিন দায়িত্ব।

সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর মত ‘ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাই স্কুলেও’ বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে কালো পতাকা উত্তোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছালেহা বেগম একাই।

সরকারি অফিসার এর মেয়ে বলে মারধর করা হয়নি, কিন্ত কথার ধারালো তীর ছালেহা বেগমের বুকে বিদ্ধ করাতে সেদিন দ্বিধা করেননি স্কুলের প্রিন্সিপাল এবং জেলা মেজিস্ট্রেট ও ডিসি এম. এ মজিদ। যার হুকুমে ছালেহা বেগমকে স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গের অযুহাতে কঠিন শাস্তি স্বরূপ তিন বছরের জন্য বহিস্কার ঘোষণা করা হয়। লজ্জায় গ্লানিতে ফেটে তখন ছালেহা বেগমের মনে হয়েছিল ‘ছাত্র জনতার গুলি খেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল’ তা হলে হয়তো ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের গুলির প্রতিবাদে কালো পতাকা উত্তোলনের দায়ে স্কুল ত্যাগের মতো এতো বড় লজ্জা মাথা পেতে নিতে হতো না, এই লজ্জা যে, প্রাণত্যাগ এর চেয়ে ভয়াবহ কষ্টের, অপমানজক, তা হলো একজন মেধাবী ছাত্রীর ‘ছাত্রত্ব’ হারিয়ে মা বাবার কাছে ফিরে যাওয়া।

ছালেহা বেগমকে ২৫ শে ফেব্রুয়ারি স্কুল ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তিন বছর পর ছোটদের সাথে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার মত মন মানসিকতা ও পরিবেশ তখন ছিল না বলেই পরবর্তীতে কোন স্কুলেই আর তাকে ভর্তি করানো হয়নি। ফলে তার আর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া হয়ে উঠেনি এবং অল্প বয়সেই ছালেহা বেগমকে বসতে হয়েছিল বিয়ের পিড়িতে। ছালেহা বেগমের পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে কেউ কেউ তার গৌরবোজ্জল অবদানকে হেয় করে কারো কাছে প্রকাশ করা থেকে সর্বদাই তাকে বিরত রাখতেন।

ফলশ্রুতিতে পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে ছালেহা বেগম সন্তানদের ছাড়া আর কারো কাছে তার এই ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জল অবদানের কথা প্রকাশ করেননি সেটাও ছিল খুবই যৎসামান্য।

ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে সেই অনাকংখিত বহিস্কার আদেশের কথা মনে হলেই চোখে জল আসত ছালেহা বেগমের চুপ করে একা একা কাঁদতেন, অন্য আর দশটা ছাত্রীর মত তারও নিয়মিত পরীক্ষা দিয়ে মেট্রিক পাশ করে কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার অদম্য বাসনা ছিল এবং স্বপ্ন ছিল অনেক বড় কিছু হওয়ার। কিন্ত ময়মনসিংহের অনাকংখিত বহিস্কার আদেশের জন্য তার জীবনে নেমে আসে নির্মম পরিহাস। তাই ছালেহা বেগম এর স্বপ্ন অংকুরেই শেষ হয়ে যায়।

উল্লেখ্য, যে ছালেহা বেগম এতই মেধাবী ছাত্রী ছিলেন যে বরাবরই তিনি প্রত্যেক ক্লাসে মেধা তালিকায় থাকতেন এবং সাহিত্য চর্চা খেলাধুলাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সব সময় প্রথম স্থান লাভ করে প্রচুর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তৎকালীন দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই ১৯৫৮ সালে তিন বোন অর্থাৎ ছালেহা বেগম ও তার দুই বোন রওশন আরা বাচ্চু ও হোসনে আরা বেগম এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মেয়েদের পড়ালেখার কথা চিন্তা করে কুলাউড়া উছলাপাড়া নিজ বাড়ীর সামনেই ‘আমতৈল’ এর হেড স্যার 'বিধু বাবুর' সহায়তায় মাত্র ১১ জন ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যলয়ের যাত্রা।

যার প্রথম প্রধান শিক্ষয়ীত্রি ছিলেন বড় বোন রওশন আরা বাচ্চু এবং তার সাথে তার ছোট দুই বোন ছালেহা বেগম ও হোসনে আরা বেগম এর সর্বাত্মক সহযোগীতায় বিনা বেতনে মেয়েদের পড়ানো শুরু করেন কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেই স্কুলেই বর্তমানে ছাত্রী সংখ্যা হাজারেরও বেশি।

আমারসংবাদ/কেএস