Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

রাতে একান্তে সময় দিতেন নেহা, সরবরাহ করতেন মদ-তরুণী

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২১, ১০:০০ এএম


রাতে একান্তে সময় দিতেন নেহা, সরবরাহ করতেন মদ-তরুণী

রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় তার বান্ধবী ফারজানা জামান ওরফে ডিজে নেহাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে অন্ধকার জগতের চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গত বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) গ্রেফতারের পর শুক্রবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে নেহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রিমান্ডের চতুর্থ দিনে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন নেহা।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে অশ্লীল জগতে পা বাড়ানো নেহার টার্গেট ছিলো ধনী পরিবারের তরুণ-তরুণীরা। বিশেষ করে নামি দামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিকেই ছিলো তার বিশেষ আকর্ষণ। টার্গেটকৃতদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরিতে তার হয়ে একাধিক উশৃঙ্খল তরুণ-তরুণী মাঠ পর্যায়ে কাজ করতো। যাদেরকেও বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা দিতো ডিজে নেহা। শিশা পার্টি, মদ পার্টি এবং অশ্লীল নাচের আয়োজনে দাওয়াত পেত সমাজের উচ্চ বিত্তের সন্তানরা। যারা নেহার হাত ধরেই বেলাল্লাপনায় জড়িয়ে পড়ে।

নেহার বাবা একজন মাঝারি স্তরের ব্যবসায়ী। থাকেন রাজধানীর আজিমপুরে। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুরান ঢাকায়। অন্যদিকে নেহার মা থাকেন মিরপুরে। দীর্ঘদিন যাবত এই বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। একরকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে বেড়ে উঠে নেহা। পড়াশোনার দৌঁড়ও বেশি দূর নয়, স্কুলের গন্ডিতেই তার সমাপ্তি ঘটে। মেধাবী হলেও পরিস্থিতির কারণে পড়াশোনায় এগুতে পারেনি সে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেহা বিপথে যাওয়ার নেপথ্যে তার বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব উল্লেখযোগ্য।

প্রাথমিকভাবে জানা যায়, কয়েক বছর আগে লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তির সঙ্গে নেহার বিয়ে হয়। ওই প্রবাসী লন্ডনে গিয়ে নেহাকেও তার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু, নানান অজুহাতে নেহা সেখানে যেতে পারছিলেন না। লন্ডনে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টাও নাকি করেছিলেন। তবে, নেহার বিয়ের বিষয়ে পুলিশ সন্দিহান।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নেহা জানিয়েছেন মূলত বিলাসী জীবন-যাপনের জন্যই এই পথ বেছে নেন তিনি।

‘রাতভর মাস্তি হবে আনলিমিটেড। আনন্দ দিতে পুরো টিম নিয়ে প্রস্তুত আমরা। এই আয়োজন আপনার জন্যই। আমাদের টিমে রয়েছে বেশ কিছু অসাধারণ সুন্দরী, স্মার্ট, ভদ্র, শিক্ষিত মেয়ে ও ভাবি বয়সের নারী। বিটের তালে তালে নাচে-গানে মুগ্ধ হতে, অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে অংশ নিন আমাদের আয়োজনে।’ এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতেন নেহা।

এসব পার্টিতে অংশ নেন ব্যবসায়ী, মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরিজীবী ও বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরা। গুলশানের নিকেতন, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গলসহ বিভিন্ন এলাকায় আয়োজন করা হয় এসব পার্টির। কখনও কখনও নৌবিহারের আয়োজন করা হয়।

বিলাসবহুল লঞ্চে নাচ, গান থেকে শুরু করে থাকে চিত্ত বিনোদনের যাবতীয় আয়োজন।

নেহার দামি পোশাক থেকে শুরু করে হাতের মোবাইলফোনটি উপহার পাওয়া। নেহা ব্যবহার করেন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের আইফোন টুয়েলভ প্রো ম্যাক্স। এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রথমবার মেশার পরই এই ফোনটি গিফট পান তিনি। এজন্য নিজ থেকেই একটা দামি ফোন প্রয়োজন বলে জানিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ীকে। চট্টগ্রামের ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো আরও কয়েক ডিজে ও মডেলদের।

রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) রিমান্ডের তৃতীয় দিনে নেহার ফোনবুকে পুলিশ ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ডজনখানেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর নাম্বার পেয়েছে। যেগুলো সাংকেতিকভাবে সংরক্ষণ করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন নেহা। কখনও কখনও রেগে যান।

তিনি জানান, সমাজে ভালো মানুষের মুখোশপড়া যারা তাদের অনেকের আসল চরিত্র তার জানা। এখন তাকে সবাই খারাপভাবে দেখছে। কিন্তু যারা তাকে ডাকেন, যারা এসব পার্টিতে অংশ নেন, রাতভর নারী ও মদে বুঁদ হয়ে থাকেন তাদেরকে কেউ খারাপ বলার সাহস পাবে না। তবে এ বিষয়ে তিনি কারও নাম বলতে চান না।

তার মোবাইলফোনে হোয়াটসঅ্যাপে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদেবার্তা। বিভিন্ন ধরণের ছবি, ভিডিও, টিকটক। এসব ছবিতে স্বল্প পোশাকপড়া নেহা। পাশে বসা, দাঁড়ানো যুবক ও মধ্য বয়সী পুরুষ। ছবি রয়েছে অনেক তরুণীদের সঙ্গেও।

এরমধ্যে এক মধ্য বয়সী ব্যক্তি সম্পর্কে নেহার তথ্য হচ্ছে, প্রবাসী ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে বনানীর একটি তারকা হোটেলে পরিচয় হয়েছিলো তার। ওই ব্যবসায়ী যখনই দেশে আসেন ডাক পড়ে নেহার। কখনও কখনও ওই প্রবাসীর অন্য বন্ধুদের জন্য নিজের বান্ধবীদেরও নিয়ে যান নেহা। রাতভর মাস্তি হয়ে হোটেলে। কখনও কখনও উত্তরার একটি বাসাতেও যান তিনি।

গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামের এক গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। শুরু থেকেই ওই ব্যবসায়ী বেশ আকৃষ্ট ছিলেন তার প্রতি। ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনের গল্প শুনিয়ে কয়েক মাসে তিন-চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।

চট্টগ্রামের মাহতাব নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় ছিলো নেহার। নেহার মাধ্যমে অনেক তরুণীদের সঙ্গে পরিচয় হয় মাহতাবের। তারপর তাদেরও ডাকতেন। নিজের কাছে ছাড়াও পাঠাতেন বিভিন্ন জনের কাছে। চট্টগ্রামের ওই ব্যসায়ীরা প্রায়ই তরুণীদের দেশের বাইরে নিয়ে যেতেন। নেহাসহ আরেক তরুণীর বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু করোনার কারণে যাওয়া হয়নি। নেহাকে বন্ধুর মতো পাশে থেকে সকল অপকর্মে সহযোগিতা করতেন শাফায়াত জামিল বিশাল। নেহা পুলিশকে জানান, বিশার তার চাচাতো ভাই।

জিজ্ঞাসাবাদে পার্টির আয়োজকদের সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছেন নেহা। নেহা জানিয়েছেন, এটা গোপন কিছু না। সবাই জানে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েও পার্টির আয়োজন করা হয়। একান্তে সময় কাটানোর জন্য ডজন খানেক বিভিন্ন বয়সের নারী থাকে এসব পার্টিতে। কর্মাশিয়াল পার্টিতে নতুন ক্লায়েন্টদের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে ওঠে বলে জানান তিনি।

গত ২৮ জানুয়ারি উত্তরার ব্যাম্বু স্যুট রেস্টুরেন্টে ইউল্যাব শিক্ষার্থীদের মদপান করাতে নেহা ও তার খুব কাছের বন্ধু আরাফাত পার্টির আয়োজন করেন। মদপানের পর অসুস্থ হয়ে আরাফাতও মারা গেছেন। সেদিন নেহার ফোনেই তার চাচাতো ভাই শাফায়াত জামিল ওরফে বিশাল এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে মদ কিনে নিয়ে যায় ওই রেস্টুরেন্টে।

নেহা পুলিশকে জানিয়েছেন, খদ্দেরদের তালিকা সংরক্ষণ করতেন বিশাল। এছাড়াও অবৈধ দরদামে সে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মাধুরীর মৃত্যুর পর তার বাবার মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসাবে নিজেই আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন বিশাল। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া ওই ছাত্রীর ছেলে বন্ধু আরিফ এবং তাদের বাসায় আশ্রয়দাতা তাফসিরও কারাগারে আটক রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট মামলার এজহারনামীয় ৪ নম্বর আসামি ডিজে নেহাকে রাজধানীর আজিমপুর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গোপন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নেহার অপরাধ নেটওয়ার্কিংয়ে মাধ্যমেই উল্লেখ্য ৫ জন একে অপরে বন্ধুতে রূপান্তরিত হয়ে বলে জানা গেছে।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশিদ বলেছেন, নেহাকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। এসব যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে। যদি মামলার তদন্তের স্বার্থে লাশ তোলা প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করে তোলা হবে।

আমারসংবাদ/জেআই