Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখল করে ৬৪ লাখ টাকায় বিক্রির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১, ১০:৫০ এএম


যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখল করে ৬৪ লাখ টাকায় বিক্রির অভিযোগ

সিরাজুল ইসলাম ভূইয়া (৭৩)। তিনি একজন যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে ২০০০ সালের ৮ আগস্ট সরকার রাজধানীর মিরপুর পল্লবীতে ৭/২২ নম্বর প্লটটি একটি একতলা বাড়িসহ বরাদ্দ দেয়। সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন সিরাজুল ইসলাম। সেই বাড়িটি ভূমিদস্যুরা স্ত্রী সন্তানদের ‘মেরে ফেলার হুমকি’ দিয়ে দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ওই বাড়িটি আরেক ব্যক্তি এস এম আহসান উল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেয়। সরকারি বরাদ্দ পাওয়া বাড়িটি হাতছাড়া হওয়ায় ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন ওই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা।

নিজের থাকার জায়গাটি ফেরত পেতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দফতরে ঘুরেও কোনো কাজ হয়নি বলে অভিযোগ করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। এখন তিনি আর স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছেন না। তবে মৃত্যুর আগে বরাদ্দ পাওয়া বাড়িটি ফেরত পেলে অন্তত শান্তি পেতেন বলেন আশা করেন তিনি।

সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া ১৯৭১ সালে ২ নং সেক্টরের হয়ে তারাব, বরপী, আড়াই হাজারসহ আশেপাশের এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তার ডান হাত এবং ডান কোমরে গুলির আঘাত লেগেছে। তিনি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। ডান হাত দিয়েও তেমন কিছু করতে পারেন না। অনেক কষ্টে কথা বলেন তিনি। তিনি এখন নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জের রূপসী এলাকায় পরিবার নিয়ে মানবেতন জীবনযাপন করছেন।

মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘পল্লবীর ৭/২২ এর চার দশমিক ৩৭ কাঠার ওই একতলা বাড়িটি ২০০০ সালে সরকার থেকে বরাদ্দ পান। পরিবার নিয়ে সেখানেই বাস করে আসছিলেন। ওই সময় পল্লবীর ১৮৬, আলুব্দি এলাকার হাজী জহির উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের জের ধরে ২০১১ সালের ২৩ মে স্ত্রী সন্তানদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে গিয়ে আম মোক্তারনামা ৫৯৯৮ নং দলিল মূলে এক পাওয়ার রেজিস্ট্রি করে নেন। ওই বছরের ২৫ মে সম্পত্তির সব কাগজপত্র ছিনিয়ে নেন। আমি পরিবার ও সন্তানদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কোনোপ্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারিনি। সন্তানেরা এখন বড় হওয়ায় মনোবল ফিরে পাই।’

তিনি বলেন, ‘গত ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই সকল আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাওয়ার দলিল ৪৪৮৪ নং দলিল মূলে উক্ত পাওয়ার বাতিল করে দেই। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট আনুমানিক রাত সাড়ে ৮টার দিকে হাজী জহির উদ্দিন মাতব্বরের বাসায় গিয়ে সম্পত্তির মূল কাগজপত্রাদি ফেরত চাইলে আমাকে হুমকি দিয়ে বলে, আর কোনো দিন কাগজ বা জমি ফেরত চাইলে সে আমার বড় ধরনের ক্ষতি করবে। আমাকে নির্বংশ করে দেওয়ারও হুমকি দেন। আমি ভীষণ অসুস্থ এবং আমার পরিবারের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে আমার নিকট আত্মীয় মো. মাসুদুর রহমানকে (৬০) ওই সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দিই।’

মাসুদুর রহমান গত বছরের ১০ অক্টোবর ওই বাড়িতে গেলে সেখানে বসবাসরত বেগম রিলুফা ও তার স্বামী এস এম আহসান উল্লাহ বাসায় প্রবেশ করতে দেননি। এমনকি তারা হুমকি দেন যে, আবার যদি এই বাড়িটি দখল করতে আসা হয় তাহলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। এমনকি তারা প্রাণনাশেরও হুমকি দেন।

পরে গত ১০ জানুয়ারি পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) (১৩৮১) করেন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া।

জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার এসআই কামরুল ইসলাম বলেন, ‘জমি জমা বা বাড়ির বিষয়ে পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না মর্মে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে তেমন কিছুই বলতে পারবো না।’

এক প্রশের উত্তরে এসআই কামরুল বলেন, ‘যিনি জিডি করেছেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর যিনি এখন বাড়িটিতে আছেন তিনিও নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন। তবে তিনি বাড়িটি জহির মাতব্বরের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন বলে দাবি করছেন। এখন কোনো একপক্ষ আদালত থেকে রায় নিয়ে আসলেই বিষয়টির সঠিক সুরাহা হবে। তার আগে, পুলিশ কিছুই করতে পারছে না। যাকে বের করে দেব তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাকে বের করে দিলে তখন সাংবাদিকরাই লিখবেন যে, মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল পুলিশ।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই বাড়িতে বসবাসরত এস এম আহসান উল্লাহ বলেন, ‘বাড়িটি আমি বরাদ্দ পাইনি। তবে এক বছর হলো নিজের নামে বরাদ্দের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে আহত নই। যার নামে বাড়িটি বরাদ্দ হয়েছিল তিনি নাকি জহিরের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। জহিরের কাছ থেকে পরবর্তীতে আমি ৬৪ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছি জমিসহ বাড়িটি। প্রায় ৭/৮ বছর হবে এই বাড়িটিতে বসবাস করছি।’

তবে জহিরের কাছ থেকে সিরাজুল ইসলাম কোনো টাকা নেননি বলে জানান।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৬৪ লাখ গেছে, প্রয়োজনে ১০ কোটি গেলেও বাড়িটি ছাড়ব না। আমি মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামকে চিনি না। কারন তার কাছ থেকে আমি বাড়িটি ক্রয় করিনি। আইনি প্রক্রিয়ায় যে পাবে সেই উঠবে এই বাড়িতে।’

বাড়িটির বিষয়ে জানতে চেয়ে হাজী জহির উদ্দিন মাতব্বরের সঙ্গে কথা বলতে পল্লবীর বাসিন্দা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের নিকটাত্মীয় মাসুদুর রহমানের সহায়তা চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘গত ছয়মাস হয়েছে হাজী জহির উদ্দিন মাতব্বর প্যারালাইজড হয়েছেন। এ কারণে তার দুই চোখ দিয়ে আর দেখতে পারছেন। কথাও ঠিকভাবে বলতে পারেন না।’

মাসুদুর রহমান বলেন, ‘মূলত এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছেন আহসান উল্লাহ। তিনি বলে বেড়াচ্ছেন যে, জহিরের কাছে ৬৪ লাখ টাকায় জমিসহ বাড়িটি কিনে নিয়েছেন। যদি কিনেই থাকেন তাহলে তিনি আবার বাড়ি বরাদ্দের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন?’

জমিসহ বাড়িটি ফিরে পেতে কোথায় কোথায় গেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। তদন্তের জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।’

ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, ওই বাড়িটিতে গেলে তাদেরও নাজেহাল করা হয়েছে। এখন এ সংক্রান্ত ফাইলটি মন্ত্রীর টেবিলে সিদ্ধান্তের অপেক্ষার জন্য রাখা হয়েছে।

আমারসংবাদ/জেআই