Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

বর্তমান নৈরাজ্যের শেষ কোথায়?

জানুয়ারি ১৯, ২০১৫, ১০:০৯ এএম


বর্তমান নৈরাজ্যের শেষ কোথায়?

  

রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথাই মনে পড়ছে, ‘কাকে দিবে দোষ, কাহারে করিবে রোষ?’ অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, অসহায় ভাবে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোন প্রতিকার দেখছি না বাংলাদেশের বর্তমান নৈরাজ্যের। ভাগ্যে বিশ্বাস করিনা তবুও ভাগ্যের দোষ বলে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের। না হলে একটি স্বাধীন দেশের জনগণের এতটা কষ্ট কেন পেতে হবে? এখন মনে হচ্ছে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারিরাই একধরনের ভালো কাজ করেছিলো, তারা জনগণকে বর্তমানের মত এত কষ্ট দেয় নাই। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে গণতন্ত্রের জন্য আরো কষ্ট পেতে হবে, আরো অনেক রক্ত দিতে হবে। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত গণতন্ত্র এক পায়ে হাঁটছে। কবে থেকে দুপায়ে হাঁটবে তা আমাদের জানা নেই।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে যার যার সুবিধামত, যার যার দলীয় দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে। আমাদের দেশে শিক্ষার হার যত কম, তারা অধিক কম সুশিক্ষার। তাই মনীষী ভল্টেয়ারের সেই কথাটি কারোই মনে দাগ কাটে না যে, ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত না হতে পারি কিন্তু তোমার মত রক্ষপার জন্য দরকার হলে আমার জীবন বিসর্জন দেবো।’ একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপকের মুখে এমন একটি কথা শুনেছিলাম, ‘ÔIf we cannot agree let us agree to disagree.' এমন কালচার আমাদের দেশে গাড় উঠতে পারলো না। তাই আমরা মামুলি সভ্য হয়েই রইলাম, সুসভ্য আর হতে পারলাম না।

১৯৭১ সালে বহুমুল্যে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যবিন্দু ধরে আমরা অগ্রসর হইনি, এজন্য একের পর এক আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। যেখানে রাজনীতি হবে মানুষের সর্বৈব কল্যাণের জন্য সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতি অকল্যাণের সংহার মূর্তি ধারন করেছে। ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে, আড়াই লক্ষ মা- বোন ইজত দিয়েছে, কয়েক লক্ষ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তার পরও স্বাধীন দেশে সাধারণ মানুষ তার জীবনের নিরাপত্তা খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ‘ভিক্ষায় কাজ নেই কুত্তা খেদাও।’

এই যে কর্মজীবী মানুষেরা, ব্যবসায়ীরা, পরিবহনের মালিক-শ্রমিকেরা অবরোধের মধ্যে পড়ে ঘরে বসে আহাজারি করছে, এর প্রতিকার কোথায় পাবো? অবরোধের মধ্যে আমি নিজে ঢাকা যাওয়া-আসা করেছি নদী পথে। তখন মানুষের মুখে অত্যন্ত বিরক্তি, অত্যন্ত ভীতির প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছি। অবরোধের প্রতি জনগণের ন্যূনতম সমর্থন ছিলো এমন চিহ্ন লক্ষ্য করিনি। ২০ দল কথা নয়, যারাই হরতাল-অবরোধ দেবে তারাই ব্যর্থ হবে, জনগণের বিরক্তির মুখে পড়বে। অতীতের সফল অবরোধ-হরতালের প্রতি যে ঐতিহাসিক সমর্থন জনগণ দিয়েছিলো, বর্তমানে তা দিচ্ছেনা। স্পষ্টতই জনগণ লক্ষ্য করছে যে, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর যে উগ্র রাজনীতি দেশে হচ্ছে তা সঠিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে না। দুই দেশের সরাসরি যুদ্ধেও বেসামরিক লোক হত্যা করা যুদ্ধের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। অথচ ক্ষমতা প্রত্যাশীরা সরকারকে জব্দ করার জন্য জনগণকে জিম্মি করেই ক্ষান্ত হয়নি, বেসামরিক সিভিল মানুষকে নির্বিচারে আগুন দিয়ে, বোমা ছুঁড়ে হত্যা করছে। এই রক্তরাঙা হঠকারিতার মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা কোথায়?

বাংলাদেশের ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, কেবলই রাষ্ট্রীয় সম্পদ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বার্নইউনিট অগ্নিদগ্ধ মানুষের হাহাকার কবে থামবে তা জানি না। মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গন থেকে ‘মানবতা’ পুড়ে ভস্ম হচ্ছে। ইংরেজ ও পাকিস্তানি আমলে যা হয় নি এখন তাই হচ্ছে। শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। অথচ নিয়ম হলো যুদ্ধের মাঠে দুই পক্ষের সৈনিক মারা যাবে, আর রাজনৈতিক যুদ্ধে দুই পক্ষের নেতা ও ক্যাডাররা মারা যাবে। না, তা হচ্ছে না। মারা যাচ্ছে সিভিল সমাজের সাধারণ মানুষ। শামসুন্নাহার নামের দুই শিক্ষিকাতো নির্দলীয় সাধারণ মানুষ। ভ্যানচালক, রিক্সা চালক, বাসের হেলপার, গার্মেন্টের চাকুরিজীবী, নিরীহ পথচারি, এরা বোমার আগুনে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। এই রাজনীতির মধ্যে সাংগঠনিক র্চ্চা, গণতন্ত্রের চর্চা, কল্যাণের চর্চা, কোনটা হচ্ছে? শেখ ফজলুল হক মনির ‘দূরবীন দূরদর্শী’ বইতে পেলাম, তিনি ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল সার্থক করার জন্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধন্যা দিয়েছেন। ৭ জুনের আগে এক সপ্তাহ পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা পিকেটিং করেছেন। তারপর হরতাল সফল হয়েছে। মানুষ জিম্মি করেননি। আর এখন হরতাল -অবরোধ সফল করার দায়িত্ব নিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। যাদের চোখে মুখে জিঘাংসা, হাতে বোমা। ধপধপ করে নিরীহ মানুষ তাদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে।

কোন অজনপ্রিয় সরকারকে অচল করে দেবার জন্য সেই দেশের সেক্রেটারিয়েট অচল করলেই কাজ সমাধা হবে। তা কেন করা হচ্ছে না? মানুষের পেটে লাথি মারা হচ্ছে কেন? মানুষের বুক থেকে সন্তান, জনক-জননী কেড়ে নেয়া হচ্ছে কেন? আপনাদের ব্যর্থতার দায়ভাগ জনগণ নেবে কেন? পত্রিকায় দেখলাম, আন্দোলনকারি প্রধান দলের নেতারা সুন্দরবন আনন্দ ভ্রমণে গেছেন। তাতো যাবেনই, আগুনের আঁচতো তাদের গায়ে লাগার কথা নয়। তাছাড়া আন্দোলন ঘোষণা করার দায়িত্ব তাদের, আন্দোলনের নামে নাশকতা-নৈরাজ্য করার দায়িত্ব জামায়াত-শিবিরের। তাই তারা প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছেন। রোম যখন পোড়ে নীরো তখন বাঁশি বাজায়।
সাধারণ মানুষ গলাটিপে হত্যার রাজনীতি কবে শেষ হবে, আমরা তা জানতে চাই। দুই পক্ষের আসুরিক লড়াই কবে শেষ হবে, তাও আমরা জানতে চাই। রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে কিনা, রাজনীতি সংসদ কেন্দ্রিক হবে কিনা, নির্বাচন কমিশনকে ভারতের মত শক্তিশালী করা হবে কিনা, সংসদ বর্জনের অপরাজনীতি শেষ হবে কিনা আমরা তা জানতে চাই। রাজনীতিকে হঠকারিতা থেকে মুক্ত করা খুবই জরুরী। দেশের মানুষকে জিম্মি করে কোন রাজনীতি হতে পারে না। সরকারকে জব্দ করার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা উচিত। সরকারের প্রশাসন, সচিবায়লয়, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, এ সব পারলে অচল করেদিন। মানুষকে তাদের মত করে বাঁচতে দিন, তাদের মত চলতে দিন, দম ছাড়তে দিন, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দিন। মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার রাজনীতি বন্ধ করুন। সরকারের সঙ্গে কৌশলে না পেরে মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এটা কেমন রাজনীতি?

এখন অবরোধ বলতে শুধু যানবাহন বন্ধ আছে ভাংচুরের ভয়ে। আর সবতো চলছে। চলার এই পথ বন্ধ করার জন্য শিবিরের সন্ত্রাসীরা পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। এই চরম হঠকারি, ধবংসাত্মক নৈরাজ্যময় অবরোধ কবে শেষ হবে, আমরা তা জানতে চাই। আমাদের জানার অধিকার আছে।